December 13, 2024, 6:36 pm
মোঃ আবদুর রহমান
জিংক বা দস্তা আমাদের শরীরে জন্য খুব প্রয়োজনীয় একটি খনিজ লবণ। সুস্থ শরীরে অতি সূক্ষ্ম পরিমাণে জিংক বিদ্যমান থাকে। এটি মানব শরীরের কার্যক্রম ঠিক রাখার জন্য জরুরি পুষ্টি উপাদান। জিংক শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। দেশে পাঁচ বছরের বয়সি ৪১ শতাংশ শিশু জিংকের অভাবে ভুগছে। আবার বিভিন্ন বয়সী ৫৭ শতাংশ নারীর রয়েছে জিংক স্বল্পতা। ১৫ থেকে ১৯ বছরের শতকরা ৪৪ ভাগ মেয়ে জিংকের অভাবে বেটে হয়ে যাচ্ছে।
এর সমাধান খুঁজতেই ভাতের মাধ্যমে জিংকের অভাব দূর করতে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা কয়েকটি জিংকসমৃদ্ধ জাতের ধান উদ্ভাবন করেছেন। এদের মধ্যে ব্রিধান-৭২ একটি জিংক সমৃদ্ধ উচ্চফলনশীল জাতের আমন ধান। জিংক ছাড়াও এ জাতের ধানের চালে পর্যন্ত প্রোটিন রয়েছে। ব্রিধান-৭২ জাতটি গড়ে হেক্টর প্রতি ৫.৭ টন ফলন দিতে সক্ষম। তবে উপযুক্ত পরিচর্যায় ৭.৫ টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। জীবনকাল কম হওয়ায় ধান কর্তনের পর অনায়াসে গম, সরিষা বা ডাল জাতীয় ফসল চাষ করা যায়।
এর সমাধান খুঁজতেই ভাতের মাধ্যমে জিংকের অভাব দূর করতে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা কয়েকটি জিংকসমৃদ্ধ জাতের ধান উদ্ভাবন করেছেন। এদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ধান-১০০ একটি জিংক সমৃদ্ধ উচ্চফলনশীল নয়া জাতের বোরো ধান। এজাতের ধানের চালে জিংকের পরিমাণ প্রতি কেজিতে ২৫.৭ মিলিগ্রাম, যা জিংকের অভাব পূরণে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। এ ছাড়া এর চালে ৭.৮% প্রোটিন রয়েছে। বঙ্গবন্ধু ধান-১০০ জাতটি গড়ে হেক্টর প্রতি ৭.৭ টন ফলন দিতে সক্ষম। তবে উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে এজাতটি প্রতি হেক্টরে ৮.৮ টন পর্যন্ত ফলন দিতে পারে। এজাতের ধানের দানা ব্রিধান-৪৯, নাইজারশাইল ও জিরা ধানের দানার মতো। তাই দেশের যেসব এলাকায় বোরো মৌসুমে জিরা নামক ধানের চাষ করা হয়, সেসব জায়গায় এজাতটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাবে বলে আশা করা যায়।
বঙ্গবন্ধু -১০০ জাতের বৈশিষ্ট্যঃ
এজাতের ধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি অধিক ফলনশীল এবং জিংক সমৃদ্ধ। পূর্ণ বয়স্ক ধান গাছ ১০১ সে.মি. পর্যন্ত লম্বা হয়। বঙ্গবন্ধু-১০০ জাতের ধান গাছের ডিগ পাতা খাড়া, লম্বা ও চওড়া এবং পাতার রং সবুজ। এজাতের ধানের জীবনকাল ১৪৮ দিন, যা ব্রিধান-৭৪ এর প্রায় সমান। এর গড় ফলন হেক্টর প্রতি ৭.৭ টন। এফলন ব্রিধান-৭৪ এর চেয়ে ৪.৫% এবং ব্রিধান-৮৪ এর চেয়ে ১৯% বেশি। তবে উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে বঙ্গবন্ধু ধান-১০০ জাতটি প্রতি হেক্টরে ৮.৮ পর্যন্ত ফলন দিতে সক্ষম। ধানের দানার রং খড়ের মতো। এক হাজার পুষ্ট ধানের ওজন ১৬.৭ গ্রাম। চালের আকৃতি মাঝারি চিকন এবং রং সাদা। এর চালে জিংকের পরিমাণ প্রতি কেজিতে ২৫.৭ মিলিগ্রাম, যা জিংকসমৃদ্ধ বোরো ধান ব্রিধান-৭৪ এর চেয়ে বেশি। এছাড়া চালে ২৬.৮% অ্যামাইলোজ এবং ৭.৮% প্রোটিন রয়েছে।
চাষাবাদ পদ্ধতিঃ
উপযোগী জমি ও মাটি ঃ মাঝারি উঁচু ও মাঝারি নিচু প্রকৃতির এঁটেল, এঁটেল দো-আঁশ, দো-আঁশ ও পলি দো-আঁশ মাটি এজাতের ধান চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে।
জমি তৈরিঃ ধানের চারা রোপণের জন্য জমি কাদাময় করে উত্তমরূপে তৈরি করতে হবে। এজন্য জমিতে প্রয়োজন মতো পানি দিয়ে মাটি একটু নরম হলে ১০-১৫ সেঃমিঃ গভীর করে সোজাসুজি ও আড়াআড়ি ভাবে ৪/৫ টি চাষ ও মই দিতে হবে যেন মাটি থকথকে কাদাময় হয়। প্রথম চাষের পর অন্ততঃ ৭ দিন জমিতে পানি আটকে রাখা প্রয়োজন। এর ফলে জমির আগাছা, খড় ইত্যাদি পচনের ফলে গাছের খাদ্য বিশেষ করে এ্যামোনিয়াম নাইট্রোজেন জমিতে বৃদ্ধি পায়। উত্তমরূপে কাদা করা তৈরি জমিতে আঙুলের সাহায্যে ধানের চারা রোপণ সহজ হয়। তাই শেষ চাষের পর বারবার মই দিয়ে জমি সমতল করে নিতে হবে, যাতে সেচের পানি জমিতে সমানভাবে দাঁড়াতে পারে।
সার ব্যবহারঃ বোরো মৌসুমে ধানের আশানুরূপ ফলন পেতে জমিতে পরিমাণ মতো জৈব ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করা দরকার। বঙ্গবন্ধু-১০০ জাতের বোরো ধান চাষের জন্য বিঘা প্রতি ৩৬ কেজি ইউরিয়া, ১৫ কেজি টিএসপি, ১৬ কেজি এমওপি, ১৫ কেজি জিপসাম ও ১.৫ কেজি জিংক সালফেট সার প্রয়োগ করতে হয়। জমি শেষ চাষের সময় সবটুকু টিএসপি, জিপসাম ও জিংক সালফেট এবং অর্ধেক এমওপি সার একসাথে মিশিয়ে প্রয়োগ করা উচিত। ইউরিয়া সার সমান তিন কিস্তিতে যথা: চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পর ১ম, ২৫-৩০ দিন পর ২য় এবং ৪০-৪৫ দিন পর ৩য় কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে। আর বাকি অর্ধেক এমওপি সার দ্বিতীয় কিস্তি ইউরিয়ার সাথে ছিটিয়ে মাটির সঙ্গে হাত দিয়ে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। এতে সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় এবং মাটিতে দূষিত বাতাস থাকলে তা বের হয়ে যাবে।
চারা রোপণঃ বঙ্গবন্ধু-১০০ জাতের ধান ১৫ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর অর্থাৎ ১ হতে ১৫ অগ্রহায়ণ এর মধ্যে বীজ বপণ করে বীজতলা থেকে ৩০-৩৫ দিন বয়সের চারা সাবধানে তুলে এনে সারি করে রোপণ করতে হবে। এ মৌসুমে সারি থেকে সারি ২০ সেঃমিঃ এবং চারা থেকে চারা ১৫ সেঃমিঃ দূরত্বে লাগাতে হবে। প্রতি ৮-১০ লাইন বা সারির পর এক সারি অর্থাৎ ২৫-৩০ সে.মি. ফাঁকা জায়গা রেখে পুনরায় পূর্ববর্তী নিয়ম অনুসারে চারা রোপণ করতে হবে। এভাবে লাইন ও লোগো পর্যায়ক্রমে বজায় রেখে জমি রোপণ শেষ করতে হয়। জমির উর্বরতা ও জাতের কুশি ছড়ানোর উপর ভিত্তি করে এ দূরত্ব কম বা বেশি হতে পারে।
প্রতি গোছায় ২/৩ টি সুস্থ ও সবল চারা ২.৫-৩.৫ সেঃমিঃ গভীরে রোপণ করতে হবে। খুব গভীরে চারা রোপণ করা ঠিক নয়। এতে কুশি গজাতে দেরি হয়, কুশি ও ছড়া কম হয়। কম গভীরে রোপণ করলে তাড়াতাড়ি কুশি গজায়, কুশি ও ছড়া বেশি হয় ও ফলন বাড়ে। তাই কম গভীরে চারা রোপণের জন্য জমিতে ১.২৫ সেঃ মিঃ এর মতো ছিপছিপে পানি রাখা ভাল। কাদাময় অবস্থায় রোপণের গভীরতা ঠিক রাখার সুবিধা হয়। রোপণের পর জমির এক কোনায় কিছু বাড়তি চারা রেখে দিতে হয়। এতে রোপণের ১০-১৫ দিন পরে যে সব জায়গায় চারা মরে যায়, সেখানে বাড়তি চারা থেকে শূন্যস্থান পূরণ করা যায়। এর ফলে জমিতে একই বয়সের চারা রোপণ করা হয়।
সেচ ব্যবস্থাপনাঃ গাছের প্রয়োজন মাফিক সেচ দিলে সেচের পানির পূর্ণ ব্যবহার হয়। বোরো ধানের জমিতে সব সময় পানি ধরে রাখতে হবে এমন কোন নিয়ম নেই। বোরো মৌসুমে সাধারণত ধানের সারা জীবনকালে মোট ১২০ সেঃ মিঃ পানির প্রয়োজন হয়। তবে কাইচ থোড় আসার সময় থেকে ধানের দুধ হওয়া পর্যন্ত পানির চাহিদা দ্বিগুণ হয়। এ সময় জমিতে দাঁড়ানো পানি রাখতে হয়। কারণ থোড় ও ফুল অবস্থায় মাটিতে রস না থাকলে ফলন কমে যায়।
ভূ-গর্ভস্থ অথবা নদীর পানি ব্যবহার করে সেচ দিতে হবে। তবে ৩ ডিএস/মিটার এর চেয়ে বেশি মাত্রার লবণাক্ততা যুক্ত পানি কখনও সেচের জন্য ব্যবহার করা যাবে না। বোরো ধানের চারা রোপণের সময় ২-৩ সে.মি, রোপণ থেকে পরবর্তী ১০ দিন পর্যন্ত ৩-৫ সে.মি, চারা রোপণের ১১ দিন থেকে থোড় আসা পর্যন্ত ২-৩ সে.মি এবং কাইচ থোড় আসার সময় থেকে ধানের দুধ হওয়া পর্যন্ত ৫-১০ সে.মি. পানির দরকার হয়।
ধান কাটার ১০-১২ দিন আগে জমির পানি পর্যায়ক্রমে বের করে দিতে হবে। এছাড়া খেত থেকে মাঝে মাঝে পানি বের করে দিয়ে জমি শুকিয়ে নিতে হবে। এতে মাটিতে জমে থাকা দূষিত বাতাস বের হয়ে যাবে এবং চারাগুলো মাটির জৈব পদার্থ থেকে সহজে খাবার গ্রহণ করতে পারবে। তবে জমির মাটি যেন ফেটে না যায়। সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। জমিতে চুল ফাটা দেখা দেয়া মাত্র পুনরায় সেচ দিতে হবে। মাটি শুকিয়ে গেল জমি ফেটে যাবে এবং সেচের পানিও ফাটল দিয়ে চুইয়ে বিনষ্ট হবে।
আগাছা দমনঃ সাধারণতঃ বোরো ধানের বেলায় চারা রোপণের পর থেকে ৪০-৪৫ দিন পর্যন্ত জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে। এ সময়ের মধ্যে অন্ততঃ ২-৩ বার জমির আগাছা পরিষ্কার করা দরকার। খেতের আগাছা পরিষ্কার করেই ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করা উচিত। অন্যথায় আগাছার উপদ্রব বেড়ে যায়।
বিভিন্ন ভাবে আগাছা দমন করা যেতে পারে। যেমন- পানি ব্যবস্থাপনা, জমি তৈরি পদ্ধতি, নিড়ানি যন্ত্রের ব্যবহার, হাত দিয়ে টেনে উঠানো ইত্যাদি। নিড়ানি যন্ত্র ব্যবহারের জন্য ধান সারিতে লাগানো দরকার। এ যন্ত্র ব্যবহারের ফলে কেবলমাত্র দুই সারির মাঝের আগাছা দমন হয়। কিন্তু দু’গুছির মাঝের যে আগাছা বা ঘাস থেকে যায় তা হাত দিয়ে টেনে তুলে পরিষ্কার করতে হবে। সংগৃহীত ঘাসে যদি পরিপক্ক বীজ না থাকে তবে তা পায়ের সাহায্যে মাটির ভেতরে পুঁতে দিলে পঁচে জৈব সারে পরিণত হবে।
পোকামাকড় ও রোগবালাই দমনঃ বঙ্গবন্ধু-১০০ জাতের ধানে পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ প্রচলিত জাতের চেয়ে অনেক কম হয়। তবে, বোরো মৌসুমের শুরুতে শীতের প্রকোপ বেশি থাকায় পোকামাকড়ের আক্রমণ বেশ কম থাকে। কিন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে পোকার আক্রমণের তীব্রতাও বাড়তে থাকে। বোরো ধানে সাধারণতঃ মাজরা, থ্রিপস্, বাদামি গাছ ফড়িং, গান্ধি পোকা, শীষকাটা লেদা পোকা, সাদা পিঠ গাছ ফড়িং ও পাতা মোড়ানো পোকার আক্রমণ হতে পারে।
তাছাড়া বোরো ফসলে ব্লাস্ট, টুংরো, ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া ও গোড়াপঁচা, খোলপোড়া, খোলপঁচা, পাতার বাদামি দাগ ও বাকানি রোগ দেখা দিতে পারে। ধানের এসব রোগ ও পোকা দমনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
ধান কর্তনঃ বোরো ধান সঠিক সময়ে কাটা ও মাড়াই করা উচিত। চৈত্র-বৈশাখ মাসে বোরো ধান পাকে। পাকার সঙ্গে সঙ্গে ধান কেটে বাড়ি নিয়ে আসতে হয়। কারণ যে কোন মুহূর্তে ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাছাড়া নিচু জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হলে এবং কাটতে দেরি করলে বৃষ্টির পানিতে অনেক সময় পাকা ধান তলিয়ে যেতে পারে। তাই পাকা ধান মাঠে না রেখে সময়মতো কেটে নিলে ফলনের ক্ষয়ক্ষতি অনেকটা কমানো যায়।
ফলনঃ বঙ্গবন্ধু ধান-১০০ জাতটি গড়ে হেক্টর প্রতি ৭.৭ টন ফলন দিতে সক্ষম। তবে উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে এজাতটি প্রতি হেক্টরে ৮.৮ টন পর্যন্ত ফলন দিতে পারে।
লেখক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা উপজেলা কৃষি অফিস রূপসা, খুলনা।