April 24, 2024, 1:57 pm

সাংবাদিক আবশ্যক
সাতক্ষীরা প্রবাহে সংবাদ পাঠানোর ইমেইল: arahmansat@gmail.com
মামলার টাকা থেকে সার্জেন্ট পার্সেন্টেজ পান?

মামলার টাকা থেকে সার্জেন্ট পার্সেন্টেজ পান?

রাজধানীর ধানমন্ডি ৩ নম্বর সড়ক দিয়ে উল্টোপথে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী সাজেদুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। সেখানে দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্ট তাকে থামিয়ে ২ হাজার টাকা দণ্ডের মামলা দেন। দ্বিতীয়বারও একইভাবে ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করায় তাকে এই পরিমাণ টাকার মামলা দেন সার্জেন্ট। সড়ক পরিবহন আইনের ৯২-এর ১ এর ঘ ধারায় মামলা দুটি দেয়া হয়। বড় যানবাহনের ক্ষেত্রে প্রথমবার তিন হাজার এবং দ্বিতীয়বার ছয় হাজার টাকার মামলা হয়।

মামলার স্লিপ হাতে নিয়ে চলে যাওয়ার সময় ক্ষুব্ধ কণ্ঠে ওই সার্জেন্টকে উদ্দেশ করে সাজেদুল বলছিলেন, ‘নিজের লাভের আশায় আমারে মামলা দিলেন। মামলা দিলে তো পার্সেন্টেজ পাবেন, মামলা দিতে পারলেই লাভ।’

সড়ক পরিবহন আইনে মামলা দিলে সার্জেন্ট বা ট্রাফিক পুলিশ তা থেকে কমিশন পান- অধিকাংশ গাড়িচালক এমন ধারণা পোষণ করেন। সাধারণ মানুষের মধ্যেও একই ধরনের ধারণা আছে।

গাড়িচালকসহ সাধারণ মানুষ এমন ধারণা পোষণ করায় ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারাও কিছুটা বিব্রত। সার্জেন্টসহ ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করা পুলিশ সদস্যরা জানান, সড়কে আইন অমান্যের কারণে যাদেরকে মামলা দেয়া হয়, তারা ধরেই নেয় যে মামলা থেকে ট্রাফিক টাকা পায়। সাধারণ মানুষ এমনকি পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকেও ‘কত পার্সেন্টেজ পাও’ এমন প্রশ্ন শুনতে হয়।

ধারণাটা ঠিক নয় বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। মামলায় আদায় হওয়া অর্থ থেকে সংশ্লিষ্ট ট্রাফিক পুলিশ সদস্য কিছু পান না। মামলা থেকে আসা সব অর্থের পুরোটাই ব্যাংকের মাধ্যমে সরাসরি সরকারের কোষাগারে জমা হয়।

ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান বলেন, ‘এই তথ্যটি ভুল। যারা বলে ট্রাফিক পুলিশ মামলা দিলে টাকা পায়, তারা না জেনে কথাটা বলে থাকে। এমন কোনো ব্যবস্থা ট্রাফিকে নেই।’ পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে সারা দেশে মোটরযান আইনে মামলা হয়েছে ৭ লাখ ২০ হাজার ৮৯৩টি। এসব মামলা থেকে জরিমানা আদায় হয় ১৫৪ কোটি ১৫ লাখ ১১ হাজার ৪৮৮ টাকা। এর পুরোটাই ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে সরকারের কোষাগারে জমা হয়েছে।

মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করা সার্জেন্ট ও ট্রাফিক সদস্যরা মন্তব্য করেন, ‘সড়কে আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে অকারণেই আমাদেরকে দোষী হতে হচ্ছে। চালকরা ভাবেন, আমরা পার্সেন্টেজের জন্য তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেই।’

নিউমার্কেট জোনের সার্জেন্ট হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আমার চাকরিজীবনে এই প্রশ্নটা যে কতবার শুনেছি তা গুনে শেষ করা যাবে না। ট্রাফিক মামলা দিলে কমিশন বা পার্সেন্টেজ পায়- এটা অসত্য। কিছু মানুষ ইচ্ছে করে এই তথ্যটা ছড়ায়। পুলিশকে হেয় করতে তারা এমনটা বলে বেড়ায়।’

ট্রাফিকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অপরাধ করলে তো ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি ধরবেই। আর সে রেহাই পাওয়ার জন্য নানা অজুহাত দিতে থাকবে। নতুন সড়ক পরিবহন আইনে মামলায় জরিমানার অঙ্ক অনেক বেড়েছে। এ কারণে মামলা না নিয়ে চালকরা কম-বেশি উৎকোচ দেয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু সেটা গ্রহণ করে ছেড়ে দেয়া হবে নাকি মামলা হবে, সে সিদ্ধান্ত ওই স্পটে দায়িত্বরত কর্মকর্তার।

সব কর্মকর্তা সৎভাবে দায়িত্ব পালন করেন সেটাও বলা মুশকিল। সবাই সমান নয়। কেউ কেউ অসৎভাবে চলে বলে পুলিশ ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ অপবাদগুলো পুরো বাহিনীর ওপর আসে।

ট্রাফিক সদস্যরা বলছেন, সড়কে যে পরিমাণ আইন অমান্য হয় সে তুলনায় মামলা হয় অনেক কম। কারণ গাড়ি আটকে চেক বা মামলা করা ছাড়াও সড়কে যান চলাচলকেন্দ্রিক আরও অনেক কাজ করতে হয়। রাজধানীতে বিশেষত অফিস শুরু ও শেষের সময়টাতে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতেই একটা বড় সময় কেটে যায়।

ডিএমপি রমনা জোনের সহকারী কমিশনার (ট্রাফিক) রেফাতুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পুলিশকে হেয় করার জন্য এই প্রচারটা করা হয়। চাকরিতে যোগদানের পর এই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত। মামলা থেকে আদায় হওয়া জরিমানা থেকে পার্সেন্টেজ পাওয়ার কোনো ব্যবস্থা পুলিশে নেই।

‘মামলা হওয়ার পর টাকা জমার পদ্ধতি দুটি। প্রথমত, সঙ্গে সঙ্গে জরিমানার টাকা নগদ জমা দিয়ে দায়িত্বরত সার্জেন্ট থেকে জব্দ হওয়া গাড়ির কাগজ বুঝে নেয়া। দ্বিতীয়ত, পুলিশের ডিসি অফিসে এসে টাকা জমা দিয়ে কাগজ নিয়ে যাওয়া।’

ট্রাফিক তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মো. শাহেদ আল মাসুদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পার্সেন্টেজের কোনো সুযোগ নেই। তা থাকলে সার্জেন্টরা দিনভর শুধু মামলাই দিতেন। আমরা মাসিক সভায় এমনও পাই, সারা মাসে একজন সার্জেন্ট কোনো মামলাই দেননি। শূন্য মামলার সার্জেন্টদের আবার চিঠি দিয়ে তিরস্কার করা হয়। কেননা, আমাদের এখানে সড়কে এত বেশি আইন অমান্য হয়, দায়িত্ব পালনকালে কোনো সার্জেন্ট আইন অমান্যকারী যানবাহন পাবেন না এটা হতে পারে না।’

সার্জেন্টদের উৎসাহ দিতে ডিএমপিতে প্রতি মাসে একজন সেরা সার্জেন্ট নির্বাচন করা হয়। সেটা মামলায় আদায় করা জরিমানা নয়, হিসাব করা হয় পয়েন্টে। আর সেই পয়েন্ট আসে মামলাগুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ, আইন রক্ষার ক্ষেত্রে কতটা কার্যকর, মামলা দিতে গিয়ে কত সময় বা শ্রম দিতে হয়েছে, পরিবেশ রক্ষায় কতটুকু অবদান থাকছে- এসব বিবেচনায়। রেজিস্ট্রেশন কার্ড না থাকার মামলায় পয়েন্ট বেশি, কালো ধোঁয়ায় এবং হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারের মামলায়ও পয়েন্ট বেশি।

ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, সেরা সার্জেন্টকে কমিশনারের তহবিল থেকে ৫ হাজার টাকা পুরস্কার দেয়া হয়। আর যে বিভাগে তিনি কর্মরত থাকেন সেখান থেকে ২ বা আড়াই হাজার টাকা দেয়া হয়। এ ছাড়া সম্মাননা হিসেবে সেরা সার্জেন্ট একটি ক্রেস্ট পেয়ে থাকেন।

গত বছরের ডিসেম্বরে সেরা সার্জেন্ট নির্বাচিত হন নিউমার্কেট জোনের সার্জেন্ট হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় রাতে উচ্চ শব্দে হর্ন বাজানোর কারণে লোকজন ঘুমাতে পারত না, শিশুরা আঁতকে উঠত। এ নিয়ে অভিযোগ আসার পর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে আমি রাতভর কাজ করেছি।

‘যেসব ট্রাক বা যানবাহন হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করেছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়ার পাশাপাশি হর্ন অপসারণ করেছি। অন্যান্য মামলাও ছিল। ওই মাসে আমি সেরা সার্জেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলাম। এই পুরস্কার ও স্বীকৃতি আরও ভালো কাজ করার অনুপ্রেরণা দেয়।’

পার্সেন্টেজ দেয়ার প্রস্তাব এলেও তা গৃহীত হয়নি

মামলা থেকে আদায় হওয়া জরিমানার একটি অংশ ট্রাফিক পুলিশকে দেয়ার প্রস্তাব উঠেছিল। তবে তা গ্রহণ করা হয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএমপি ট্রাফিকের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২০১৪ সালে ট্রাফিকের এক কল্যাণ সভায় প্রস্তাবটি তোলা হয়। প্রস্তাবটা ছিল এমন যে, ট্রাফিক সার্জেন্টরা এত এত মামলা দেন; তা থেকে একটা পার্সেন্টেজ তাদের দেয়া যায় কি না। ওই প্রস্তাবই রিউমার আকারে চলমান।’

ওই সভায় উপস্থিত থাকা কর্মকর্তা বলেন, ‘কাস্টমস ও বিজিবি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আসা যেসব পণ্য জব্দ করে, সেগুলো রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হওয়ার পর একটা অংশ অপারেশনে থাকা কর্মকর্তারা পেয়ে থাকেন। একইভাবে ট্রাফিক পুলিশকে দেয়ারও একটা প্রস্তাব ছিল। কিন্তু আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তা গ্রহণ করেননি।

‘যুক্তি দেখানো হয়- পার্সেন্টেজ পাওয়ার জন্য দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের অতি তৎপরতায় মামলার সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে, ক্ষেত্রবিশেষে হয়রানিও হতে পারে।’

সভায় কর্মকর্তাদের বক্তব্য ছিল- পুলিশের কাজ হচ্ছে আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এতে কমিশনের কোনো ব্যাপার নেই।


Comments are closed.

ইমেইল: arahmansat@gmail.com
Design & Developed BY CodesHost Limited
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com