October 31, 2024, 3:12 am
সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় জনপদ শ্যামনগরকে ঘিরে থাকা উপকূল রক্ষা বাঁধে দুই হাজারেরও বেশি ওভার পাইপ থাকা সত্ত্বেও পাউবো কর্তৃপক্ষ মাত্র চার জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।‘বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের অবস্থা নাজুক’ হওয়ার অভিযোগ এনে বাপাউবো এর ভেটখালী পওর শাখার উপ-সহকারী প্রকৌশলী মাসুদ রানা ১৭ নভেম্বর শ্যামনগর থানায় ২৩ ক্রমিকের মামলাটি রুজু করেন।১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৫ (৩) ধারায় দায়ের করা মামলায় শ্যামনগর উপজেলার পশ্চিম কৈখালী গ্রামের বাবলু গাজী, রাজ্জাক গাজী, ফজলুল হক ও মহিবুল্লাহ গাজীকে আসামী করা হয়েছে। এছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও পাঁচ/সাত জনকে অভিযুক্ত করে দায়ের হওয়া মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে ‘পাউবোর বেড়িবাঁধে অবৈধভাবে পাইপ স্থাপন করে বাঁধের ক্ষতি সাধন করছে’।এদিকে অভিযোগ উঠেছে দক্ষিণ-পশ্চিম এ জনপদকে ঘিরে থাকা উপকুল রক্ষা বা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে দুই হাজারেরও বেশি পাইপ থাকা সত্ত্বেও মাত্র চারজনের বিরুদ্ধে মামলা গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী একটি মহলকে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দিতে ‘প্রভাবিত’ পাউবোর পক্ষ থেকে দায়ের হওয়া মামলায় মাত্র চারজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। যদিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রভাবিত হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে ‘পর্যায়ক্রমে সকল পাইপ উঠিয়ে ফেলা হবে’-বলে জানিয়েছে। তবে মামলায় মাত্র চারজনকে অভিযুক্ত করার বিষয়ে ‘সংশ্লিষ্টদের পাইপ এলাকাবাসীর ক্ষয়ক্ষতি করছে’-মর্মে দাবি সংশ্লিষ্টদের।সরেজমিন পরিদর্শন এবং স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে সাতক্ষীরা পওর বিভাগ ১ এর ডিভিশন ২ এর আওতাধীন ৫নং পোল্ডারটি কৈখালী, নুরনগর, রমজাননগর ও মুন্সিগঞ্জসহ সংলগ্ন এলাকাকে ঘিরে রেখেছে। আর এসব এলাকার সিংহভাগ মানুষ উপকুল রক্ষা বাঁধের উপর দিয়ে ‘ওভার পাইপ’ স্থাপন করে চিংড়ি চাষ পরিচালনা করছে।অভিযোগ উঠেছে ৫নং পোল্ডারের শুধু কৈখালী ইউনিয়নকে ঘিরে থাকা উপকুল রক্ষা বাঁধে প্রায় দুই শত ওভার পাইপ বসানো রয়েছে। আর গোটা উপজেলাকে ঘিরে থাকা বাঁধে ওভার পাইপের সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে যাবে বলে খোদ পাউবো’র সেকশন অফিসার মাসুদ রানার দাবি। এমতাবস্থায় মাত্র চার জনের বিরুদ্ধে ওভার পাইপ ব্যবহার করে বাঁধের ক্ষতিসাধনের মামলা হয়রানীকর ও চক্রান্তমুলক বলে দাবি স্থানীয়দের।অভিযুক্ত ফজলুল হক জানান, ছোট মৌকাটলা খাল অবৈধভাবে প্রভাবশালীরা দখল করে নেয়ায় সামান্য বৃষ্টিতে তাদের বসতবাড়িসহ আশপাশের জমি পানিতে তলিয়ে যায়। বাধ্য হয়ে তারা চিংড়ি চাষ করেন -উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন বিভিন্ন সময়ে জনপ্রতিনিধিসহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে জলাবদ্ধতা থেকে তাদের মুক্তি দেয়ার আবেদনও জানিয়েছেন। কিন্তু কোন প্রতিকার না মেলায় বাধ্য হয়ে বসতবাড়ি সংলগ্ন ঐ এলাকায় তারা ওভার পাইপ ব্যবহার করে চিংড়ি ঘের পরিচালনা করছিলেন। সম্প্রতি স্থানীয় দলাদলির কারনে প্রতিপক্ষের নিকট থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে পাউবো কতৃপক্ষ তাদের পাইপ অপসারণে নোটিশ দেয়। কিন্তু বুলবুলের তান্ডবের পর ডুবে যাওয়া সমুদয় এলাকার পানি নিস্কাশনের জন্য তারা পাইপগুলো অপসারণ না করায় তাদেরকে হয়রানী করতে মামলা দেয়া হয়েছে।মহিবুল্লাহ নামের অপর এক অভিযুক্তের দাবি সংলগ্ন অংশে প্রায় দুই শত ওভার পাইপ রয়েছে। এমনকি অনেক জায়গাতে বাঁধ কেটেও পাইপ বসানো হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট পোল্ডারের দায়িত্বে থাকা এসও মাসুদ রানা সেসব পাইপ মালিকের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে বরং তাদের প্ররোচণায় আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। পাউবোর কার্য-সহকারী অছিউল এর দাবিকৃত অনৈতিক সুবিধা না দেয়ার বিষয়টিও মামলার পিছে কাজ করেছে বলে দাবি তার।আরাফাত হোসেন নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি অভিযোগ করেন জনৈক আফছার মাষ্টারের নিকট থেকে তিনি দুই বছরের জন্য ডিড নিয়ে পঞ্চাশ বিঘা জমিতে চিংড়ি চাষ শুরু করেছেন। ওই চিংড়ি ঘেরটির উপর স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী মহলের দৃষ্টি পড়ায় তারা পাউবো কর্তৃপক্ষকে ভুল বুঝিয়ে তাদেরকে হয়রানী করতে হামলা মামলার ভয় দেখাচ্ছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, জনৈক সওকাত সরদার ও তার লোকজন পাউবো’র স্থানীয় কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে তাদের হয়রানী করছেন। যে কারণে ১৬ নভেম্বর বিকালে সংবাদকর্মীসহ স্থানীয়দের সামনে দিয়ে সওকাত সরদারের জমিতে থাকা ওভার পাইপটি উঠিয়ে নেয়ার পর দিনই তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। সওকাত সরদারকে মামলা থেকে রেহাই দিতেই আগের দিন বিকালেই স্থানীয় দুই পাউবো কর্মচারীর পরামর্শে তার ছেলেকে দিয়ে সবার সামনে দিয়ে ওভার পাইপ উঠিয়ে নেয়া হয় বলেও দাবি তার।এদিকে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে ও সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায় পশ্চিম কৈখালী এলাকাতে বন্যা নিয়ন্ত্রন বা উপকুল রক্ষা বাঁধে অসংখ্য ওভার পাইপ যথাস্থানে রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে কোন কোন স্থানে রীতিমত বাঁধ কেটে পাইপ বসানো হয়েছে। কিন্তু এসব ব্যক্তিদের কাউকে পাউবোর পক্ষ থেকে দায়েরকৃত মামলায় আসামী না করাকে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন স্থানীয়রা। বাবলু গাজী নামের স্থানীয় এক ঘের মালিক বলেন, পশ্চিম কৈখালীর মো. আবুল কাশেম বাঁধের তলা দিয়ে পাইপ স্থাপন করেছে। এছাড়া মজিদ মোল্যা, আব্দুল কাদের বাবলে, মোহাম্মদ গাজী, আজিজ গাজী, মজিবর গাজী, নুর ইসলাম সরদার, নুর মোহাম্মদ, নুর মোহাম্মদ, আব্দুল আজিজ, আবু সাইদ, সওকাত সরদার, হাবিবুল্লাহ, মুনসুর সরদার, মো. আব্দুল মালেকসহ আরও অনেকের ওভার এবং বাঁধ কেটে পাইপ বসানো থাকা সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে এসও মাসুদ রানা ও তার কর্মচারী অছিউল ‘টু’শব্দটি পর্যন্ত করছে না। বাবলু গাজীর দাবি গ্রাম্য দলাদলির কারনে স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী এক ব্যাংক কর্মকর্তা ও সওকাত সরদারের ইন্ধনে তাদেরকে হয়রানী করার চক্রান্ত চলছে।স্থানীয় অসংখ্য অভিযোগকারীর দাবি পাশাপাশি আব্দুর রাজ্জাকসহ মোট তিন জনের তিনটি ওভার পাইপ ১৮ নভেম্বর সোমবার পর্যন্ত দৃশ্যমান রযেছে। অথচ হাবিবুল্লাহ নামের ঘের মালিককে বাদ দিয়ে অপর দুই জনকে আলোচিত এ মামলার আসামী করেছে এসও মাসুদ রানা। বাছাই করে করে ‘টার্গেট’ ব্যক্তিদের হয়রানী করতে ষড়যন্ত্রমুলকভাবে মামলা দায়ের হয়েছে অভিযোগ করে স্থানীয়রা মাসুদ রানা ও অছিউল এর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের জন্য প্রধান নির্বাহীসহ দুদক এর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। এবিষয়ে তারা মাননীয় জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপারসহ স্থানীয় সংসদ সদস্যেরও জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে সেকশন অফিসার মাসুদ রানা জানান, শ্যামনগরকে ঘিরে থাকা উপকুল রক্ষা বাঁধে প্রায় তিন হাজারের মত পাইপ রয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবগুলো পাইপ অপসারনে উদ্যোগ নেয়া হবে। শত শত পাইপ থাকা সত্ত্বেও মুষ্টিমেয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে নোটিশ প্রদানসহ মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি উর্ধ্বতন এক জনপ্রতিনিধির সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন।