October 31, 2024, 3:12 am
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা বোরো মৌসুমে চাষের জন্য কয়েকটি উচ্চফলনশীল জাতের ধান উদ্ভাবন করেছেন। এদের মধ্যে ব্রিধান-৫৮ একটি জনপ্রিয় উচ্চফলনশীল জাতের বোরো ধান। এজাতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো শিষ থেকে ধান ঝরে পড়ে না এবং অধিক ফলনশীল। উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে ব্রিধান-৫৮ চাষে হেক্টর প্রতি ৭.০ থেকে ৭.৫ টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়।
ব্রিধান-৫৮ এর বৈশিষ্ট্য:
এ জাতের ধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো শিষ থেকে ধান ঝরে পড়ে না এবং অধিক ফলনশীল। ব্রিধান-৫৮ মাঝারি ঢলে পড়া প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন যা ব্রিধান-২৮ জাতের ধানে নেই। পূর্ণ বয়স্ক ধান গাছ ১০০-১০৫ সে. মি. পর্যন্ত লম্বা হয়। অঙ্গজ অবস্থায় ধান গাছের আকার ও আকৃতি ব্রিধান-২৯ এর চেয়ে লম্বা। এ জাতের ধানের ডিগপাতা হেলানো এবং লম্বা। ধান পরিপক্ক হওয়ার সাথে সাথে ডিগপাতা বেশি হেলে থাকে। পরিপক্ক শিষগুলো ডিগপাতার উপরে অবস্থান করে। বিধায় পুরো খেত দেখতে খুব আকর্ষণীয়। এ জাতের ধানের জীবনকাল ১৫০-১৫৫ দিন। ব্রিধান-৫৮ জাতের পাকা ধানের রং খড়ের মতো। ধানের দানা অনেকটা ব্রিধান-২৯ এর মতো, তবে সামান্য চিকন। একহাজার পুষ্ট ধানের ওজন প্রায় ২৪ গ্রাম। উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে ব্রিধান-৫৮ চাষে হেক্টর প্রতি ৭.০০ টন থেকে ৭.৫ টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়।
চাষাবাদ পদ্ধতি:
উপযোগী জমি ও মাটি: মাঝারি উঁচু ও মাঝারি নিচু প্রকৃতির এঁটেল, এঁেটল দো-আঁশ, দো-আঁশ ও পলি দো-আঁশ মাটি এ ধান চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে।
জমি তৈরি: ধানের চারা রোপণের জন্য জমি কাদাময় করে উত্তমরূপে তৈরি করতে হবে। এজন্য জমিতে প্রয়োজন মতো পানি দিয়ে মাটি একটু নরম হলে ১০-১৫ সে:মি: গভীর করে সোজাসুজি ও আড়াআড়ি ভাবে ৪/৫ টি চাষ ও মই দিতে হবে যেন মাটি থকথকে কাদাময় হয়। প্রথম চাষের পর অন্তত: ৭ দিন জমিতে পানি আটকে রাখা প্রয়োজন। এর ফলে জমির আগাছা, খড় ইত্যাদি পচনের ফলে গাছের খাদ্য বিশেষ করে এ্যামোনিয়াম নাইট্রোজেন জমিতে বৃদ্ধি পায়।
সার ব্যবহার: বোরো মৌসুমে ধানের আশানুরূপ ফলন পেতে জমিতে পরিমান মতো জৈব ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করা দরকার। ব্রিধান-৫৮ জাতের বোরো ধান চাষের জন্য বিঘা প্রতি ৪০ কেজি ইউরিয়া, ১৫ কেজি টিএসপি, ১৬ কেজি এমওপি, ১২ কেজি জিপসাম ও ১.৫ কেজি জিংক সালফেট সার প্রয়োগ করতে হয়। শেষ চাষের সম সবটুকু টিএসপি, এমওপি, জিপসাম ও জিংক সালকেট সার প্রয়োগ করা উচিত। ইউরিয়া সার সমান তিন ভাগ করে চারা রোপনের ১০-১৫ দিন পর ১ম, ৩৫-৪০ দিন পর ২য় এবং ৫০-৫৫ দিন পর ৩য় কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সার ছিটিয়ে মাটির সাথে হাত দিয়ে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। এতে সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় এবং মাটিতে দূষিত বাতাস থাকলে তা বের হয়ে যাবে।
চারা রোপণ: ব্রিধান-৫৮ জাতের ধান ২০ নভেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর এর মধ্যে বীজ বপণ করে বীজতলা থেকে ৩০-৩৫ দিন বয়সের চারা সাবধান তুলে এনে সারি করে রোপণ করতে হবে। এ মৌসুমে সারি থেকে সারি ২০-২৫ সে:মি: এবং চারা থেকে চারা ১৫-২০ সে:মি: দূরত্বে লাগাতে হবে। প্রতি ৮-১০ লাইন বা সারির পর এক সারি অর্থাৎ ২৫-৩০ সে.মি. ফাঁকা জায়গা রেখে পুনরায় পূর্ববর্তী নিয়ম অনুসারে চারা রোপন করতে হবে। এভাবে লাইন ও লোগো পর্যায়ক্রমে বজায় রেখে জমি রোপণ শেষ করতে হয়। জমির উর্বরতা ও জাতের কুশি ছড়ানোর উপর ভিত্তি করে এ দূরত্ব কম বা বেশি হতে পারে। প্রতি গোছায় ২/৩ টি সুস্থ ও সবল চারা ২.৫-৩.৫ সে:মি: গভীর রোপণ করতে হবে। খুব গভীরে চারা রোপণ করা ঠিক নয়। এতে কুশি গজাতে দেরি হয়। কুশি ও ছড়া কম হয়। কম গভীরে রোপণ করলে তাড়াতাড়ি কুশি গজায়, কুশি ও ছড়া বেশি হয় ও ফলন বাড়ে। তাই কম গভীরে চারা রোপণের সময় জমিতে ১.২৫ সে: মি: এর মতো ছিপছিপে পানি রাখা ভাল। কাদাময় অবস্থায় রোপণের গভীরতা ঠিক রাখার সুবিধা হয়। রোপণের পর জমির এক কোনায় কিছু বাড়তি চারা রেখে দিতে হয়। এতে রোপণের ১০-১৫ দিন পরে যে সব জায়গায় চারা মরে যায় সেখানে বাড়তি চারা থেকে শূন্যস্থান পূরণ করা যায়। এর ফলে জমিতে একই বয়সের চারা রোপণ করা হয়। ১ জানুয়ারি থেকে ২৫ জানুয়ারি এর মধ্যে চারা রোপণ শেষ করতে হবে।
সেচ ব্যবস্থাপনা: গাছের প্রয়োজন মাফিক সেচ দিলে সেচের পানির পূর্ণ ব্যবহার হয়। বোরো ধানের জমিতে সব সময় পানি ধরে রাখতে হবে এমন কোন নিয়ম নেই। বোরো মৌসুমে সাধারণত ধানের সারা জীবনকালে মোট ১২০ সে: মি: পানির প্রয়োজন। তবে কাইচ থোড় আসার সময় থেকে ধানের দুধ হওয়া পর্যন্ত পানির চাহিদা দ্বিগুন হয়। এ সময় জমিতে দাঁড়ানো পানি রাখতে হয়। কারণ থোড় ও ফুল অবস্থায় মাটিতে রস না থাকলে ফলন কমে যায়। ধানের চারা রোপণের পর থেকে কোন অবস্থায় কতটুকু পানির সরকার তা নি¤েœর সারণিতে দেয়া হলো।
সারণি: ১।
ধান গাছের অবস্থা/সময় | পানির পরিমাণ |
চারা রোপণের সময় চারা রোপণ থেকে পরবর্তী ১০ দিন পর্যন্ত চারা রোপণের ১১ দিন থেকে থোড় আসা পর্যন্ত কাইচ থোড় আসার সময় থেকে ধানের ফুল ফোটা পর্যন্ত |
২-৩ সে:মি: ৩-৫ সে:মি: ২-৩ সে:মি: ৫-১০ সে:মি: |
ধান কাটার ১০-১২ দিন আগে জমির পানি পর্যায়ক্রমে বের করে দিতে হবে। এছাড়া ক্ষেত থেকে মাঝে মাঝে পানি বের করে দিয়ে জমি শুকিয়ে নিতে হবে। এতে মাটিতে জমে থাকা দূষিত বাতাস বের হয়ে যাবে এবং চারাগুলো মাটির জৈব পদার্থ থেকে সহজে খাবার গ্রহণ করতে পারবে। তবে জমির মাটি যেন ফেটে না যায়। সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। জমিতে চুল ফাটা দেখা দেয়া মাত্র পুনরায় সেচ দিতে হবে। মাটি শুকিয়ে গেল জমি ফেটে যাবে এবং সেচের পানিও ফাটল দিয়ে চুইয়ে বিনিষ্ট হবে।
আগাছা দমন: সাধারণত: বোরো ধানের বেলায় চারা রোপণের পর থেকে ৪০-৪৫ দিন পর্যন্ত জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে। এ সময়ের মধ্যে অন্তত: ২-৩ বার জমির আগাছা পরিষ্কার করা দরকার। খেতের আগাছা পরিষ্কার করেই ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করা উচিত। অন্যথায় আগাছার উপদ্রব বেড়ে যায়।
বিভিন্ন ভাবে আগাছা দমন করা যেতে পারে। যেমন- পানি ব্যবস্থাপনা, জমি তৈরি পদ্ধতি, নিড়ানি যন্ত্রের ব্যবহার, হাত দিয়ে টেনে উঠানো ইত্যাদি। নিড়ানি যন্ত্র ব্যবহারের জন্য ধান সারিতে লাগানো দরকার। এ যন্ত্র ব্যবহারের ফলে কেবলমাত্র দুই সারির মাঝের আগাছা দমন হয়। কিন্তু দু’গুছির মাঝের যে আগাছা বা ঘাস থেকে যায় তা হাত দিয়ে টেনে তুলে পরিষ্কার করতে হবে। সংগৃহীত ঘাসে যদি পরিপক্ক বীজ না থাকে তবে তা পায়ের সাহায্যে মাটির ভেতরে পুঁতে দিলে পঁচে জৈব সারে পরিণত হবে।
পোকা-মাকড় ও রোগ-বালাই দমন: বোরো মৌসুমের শুরুতে শীতের প্রকোপ বেশি থাকায় পোকা-মাকড়ের আক্রমন বেশ কম থাকে। কিন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে পোকার আক্রমনের তীব্রতাও বাড়তে থাকে। বোরো ধানে সাধারণত: মাজরা, থ্রিপস্, বাদামি গাছ ফড়িং, গান্ধি পোকা, শীষকাটা লেদা পোকা, সাদা পিঠ গাছ ফড়িং ও পাতা মোড়ানো পোকার আক্রমন হতে পারে।
তাছাড়া বোরো ফসলে টুংরো, ব্লাস্ট, ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া ও পোড়াপঁচা, ছত্রাকজনিত কান্ড পঁচা, খোলপোড়া, খোলপঁচা, পাতার বাদামি দাগ ও বাকানি রোগ দেখা দিতে পারে। ধানের এসব রোগ ও পোকা দমনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
ধান কর্তন: বোরো ধান সঠিক সময়ে কাটা ও মাড়াই করা উচিত। চৈত্র-বৈশাখ মাসে বোরো ধান পাকে। পাকার সঙ্গে সঙ্গে ধান কেটে বাড়ি নিয়ে আসতে হয়। কারণ যে কোন মুহূর্তে ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাছাড়া নিচু জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হলে এবং কাটতে দেরি করলে বৃষ্টির পানিতে অনেক সময় পাকা ধান তলিয়ে যেতে পারে। তাই পাকা ধান মাঠে না রেখে সময়মতো কেটে নিলে ফলনের ক্ষয়ক্ষতি অনেকটা কমানো যায়।
ফলন: উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে হেক্টরপ্রতি গড়ে ৭.০-৭.৫ টন পর্যন্ত ব্রিধান-৫৮ এর ফলন পাওয়া যায়।
লেখক: উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা উপজেলা কৃষি অফিস রূপসা, খুলনা।