February 18, 2025, 9:45 pm
আজ দুধ নিয়ে তর্ক তুলেছে রাষ্ট্র। এ যেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের আরেক ‘দুধ-ভাতে উৎপাত’। রাষ্ট্রের নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ প্যাকেটজাত পাস্তুরিত ও খোলা তরল দুধে ভয়াবহমাত্রার সিসা, অ্যান্টিবায়োটিক, কীটনাশক, ক্যাডমিয়াম, ফরমালিন ও ডিটারজেন্ট ‘আবিষ্কার’ করেছেন। আসলে কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের মতো তারা গায়ের জোরে বা মাস্তানি করে কোনো কিছু করেননি। বাজারে ও দোকানে বিক্রি হওয়া কিছু দুধের নমুনা নিয়ে পদ্ধতিগতভাবে গবেষণাগারে পরীক্ষা করিয়ে দুধের ভেতর ভয়াবহ বিষগুলো খুঁজে পেয়েছেন। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ, পরমাণু শক্তি কমিশন, আন্তজার্তিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ, প্লাজমা প্লাস ও ওয়াফেন রিসার্চের পরীক্ষাগারে দুধের নমুনাগুলি পরীক্ষা করিয়েছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে এমন একটি তৎপরতার ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অভিনন্দন। আমরা ছোটবেলা থেকে দুধের সাথে তিনটি বিষয় জেনে আসছি। ‘দুধে পানি মেশানো’, ‘দুধের মাছি’ আর ‘দুধ-ভাত’। দুধের বিশুদ্ধতা নিয়ে ঐতিহাসিকভাবেই একটা পাবলিক তর্ক ও সন্দেহ শুরু হয়েছেল এই জনপদে, তবে কবে থেকে বলা মুশকিল। আর তাই গোয়ালার দুধে পানি মেশানোকে সন্দেহ হিসেবে দেখা শুরু হয়েছিল এবং ‘গরুর খাঁটি দুধ বা খাঁটি গরুর দুধ’ এরকম বাহারি বিজ্ঞাপনও পয়দা লাভ করেছিল এই জনপদেই। দুধ যখনি একটি গ্রামীণ সমাজের সামগ্রিক উৎপাদনব্যবস্থার জটিল সম্পর্ক থেকে ছিটকে এককভাবে বাজারের পণ্য হয়ে ওঠলো বা করে তোলা হলো ‘দুধের’ উপর দুধের সাথে সম্পর্কহীন ‘ক্রেতা-ভোক্তাগণের’ এক সন্দেহমূলক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল। একটি গ্রামীণ সমাজে দুধের সাথে গৃহস্থ বাড়ির নানা মানুষ, রাখাল, গোয়ালা, গ্রামের মাঠ-ঘাট, গোচারণভূমি, ঋতুভিত্তিক খাদ্যবৈচিত্র্য, পাড়াপড়শির সম্পর্ক কতকিছু জড়িয়ে আছে। আর চলমান নয়াউদারবাদী বিশ্বায়িত বাজারে দুধ কেবলমাত্র এক করপোরেট পণ্য। এটি কবলী-ধবলী না মহেশের দুধ, এই গরু বিলের ঘাস না পরাঙ্গী ধানের খড় খেয়েছে তা কেউ কোনোদিন খুঁজতে যাবে না। হয়তো গরু বা দুধের সাথে আমাদের শহুরে জীবনের নাগরিক সম্পর্কটি ভিন্ন ধাঁচের, তাই বলে আমাদের দুধে প্রশ্নহীনভাবে কেউ বিষ মিশিয়ে যাবে? সব কিছু বাদ দিলেও এটি অন্যায়, চরম অন্যায়। কারণ ¯্রফে একজন ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে আমরা দুধ কিনছি, দুধ খাচ্ছি। আমাদের শিশু ও পরিবারের গলায় পরম মমতা ও বিশ্বাসে ঢেলে দিচ্ছি এই দুধ। আমরা তো জানতামও না আমরা মা-বাবা হয়ে এতদিন দুধের নামে আমাদের সন্তানদের মুখে বিষ ঢেলেছি। আমাদের মা-বাবাকে বিষ খাইয়ে এসেছি তাদের শরীর-স্বাস্থ্য তরতাজা রাখতে। এই বিষ মেশানো দুধের কারণে যে দীর্ঘমাত্রার ক্ষতি আমাদের স্বাস্থ্য ও শরীরে হয়েছে তার ধকল কে সইবে? কে এর দায়ভার নেবে? বিষের কারণে না হয় এখন দুধ বন্ধ হবে, কিন্তু যারা যেসব কোম্পানি এতদিন এই বিষমেশানো দুধ আমাদের খাইয়েছে তাদের বিচার করবে কে? ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে আমাদের সাথে প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতার জবাব আমরা ভূক্তভোগীরা কার কাছে চাইবো? আর এমন তো নয়; কেবল দুধেই বিষ। বাজারে বিক্রি হওয়া সকল খাদ্যপণ্যই আজ বিষাক্ত, রাষ্ট্রীয় গবেষণাতেই প্রমাণিত হচ্ছে প্রতিদিন আমাদের খাবার নিরাপদ নয়। কেবলমাত্র মানুষ নয়; প্রাণিখাদ্যও আজ আক্রান্ত ও রক্তাক্ত।
Comments are closed.