October 23, 2024, 7:07 pm
গত ১৮ নভেম্বর সাতক্ষীরা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রদূত পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্যামনগর উপজেলার ‘কাশিমাড়ীতে বাল্যবিয়ের অভিশাপ ও ইটেরভাটায় পুড়লো ২০ শিশুর ভবিষ্যৎ’। প্রকাশিত সংবাদের গর্ভে বলা হয়, সুমনা পারভীন ৫নং ঝাপা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী। এ বছর পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় তার অংশ নেয়ার কথাও ছিল। কিন্তু ইতোমধ্যে মাত্র পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া ওই শিশুকে বিয়ে দেয়ার কারণে সে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি না। একই অবস্থা শারমিন সুলতানার ক্ষেত্রেও। সে ৯নং ঘোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিতে রেজিস্ট্রেশন করেছিল। কিন্তু বাল্যবিয়ের অভিশাপ তাকেও গ্রাস করেছে। এভাবে শুধু কাশিমাড়ী ইউনিয়নেরই আরও একাধিক কন্যা বাল্যবিয়ের শিকারে পরিণত হয়ে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা থেকে ছিটকে পড়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। বাল্যবিয়ে না হলেও শিশু শ্রমিকে পরিণত হয়ে আরও প্রায় ১২-১৪ শিশু এবছর শিক্ষা সমাপনী ও এবতেদায়ী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে না। এই চিত্র শ্যামনগর উপজেলার শুধু কাশিমাড়ী ইউনিয়নের। অনুপস্থিত শিশুদের সহপাঠি ও পরিবার এবং সংশ্লি¬ষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য মিলেছে।৫৭নং জয়নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা সাজেদা খাতুন বলেন, তার বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল আশিক। ইটভাটা শ্রমিক সর্দারের থেকে দাদনের টাকা নিয়ে তার পরিবার শিশু আশিককে পাঠিয়েছে ইটভাটায়। ফলে এবছর তার প্রাথমিকের শিক্ষা সমাপনীতে বসা হলো না। একই অবস্থা ১২৬ নম্বর পূর্ব কাশিমাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাহিদুর রহমানের। কাশিমাড়ী গ্রামের ওই শিশু শিক্ষার্থীর শিক্ষা সমাপনীর হলে না যাওয়ার কারণ ইটভাটার কাজে নিযুক্ত করা হয়েছে পরিবারের পক্ষ থেকে।তবে শুধু নাহিদুর রহমান কিংবা আশিক না। এমন আরও বার থেকে চৌদ্দ শিশু কেবল মাত্র ইটভাটার কাজে যাওয়ার কারণে এবছর পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষা সমাপনী ও সমমানের এবতেদায়ী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে না। এ তথ্য আবার কেবল মাত্র উপজেলার একটি মাত্র ইউনিয়নের। একইভাবে উপজেলার অপরাপর ইউনিয়ন থেকে কমবেশী শিশুরা শিক্ষা সমাপনী ও এবতেদায়ী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে না।অনুপস্থিত শিশুদের সহপাঠি আছিয়া, জোসনা, রায়হান, সোহাগী, শামীমাসহ অন্যরা জানান, অনুপস্থিত কন্যা শিশুরা পরীক্ষা দিচ্ছে না বিয়ে হয়ে যাওয়ার কারণে ও অবহেলা করে। এছাড়া ছেলে শিশুরা ইটভাটার কাজে যাওয়ায় তারাও পরীক্ষায় অংশ নেয়া থেকে বিরত রয়েছে।এই যদি একটি ইউনিয়নের অবস্থা, তাহলে জেলার ৭৮টি ইউনিয়ন আর ২টি পৌর সভার অবস্থা কেমন তা আন্দাজ করলে শিউরে উঠতে হয়।ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বেড়েই চলেছে। এ কারণে শিশুদের দৈহিক গঠনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে। কাজের লোক হিসেবে শিশুদের দিয়ে ভারি কাজ করানো হচ্ছে। জীবিকার তাগিদে কর্মে নিয়োজিত দেশের লাখ লাখ শিশুর নীরব কান্না কেউই দেখছে না। অনেক শিশু ভিক্ষাবৃত্তির পথও বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। অনেক বাবা-মা শিশুদের অর্থ উপার্জনের তাগিদে অন্যের বাসায় কাজ করতে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে চলে শিশুদের ওপর শারীরিক-মানসিক নির্যাতন। কাজে একটু ত্রুটি হলেই শিশুদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়।শিশুশ্রম বন্ধে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ আজকাল সমাজে লক্ষ করা যায় না। রাস্তা-ঘাটে, অলিতগলিতে দেখা যায় শিশুদের ভারি কাজ করতে, ইটেরভাটায় ইট নামানো, এমনকি বাস-লেগুনায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অল্প বয়সেই শিশুরা হেল্পারি করছে। গাড়িতে-লঞ্চে পণ্য উঠানো-নামানোর কাজও করছে শিশুরা। পড়াশোনা বাদ দিয়ে অনেক শিশু দোকানে কাজ করছে। যে বয়সে শিশুদের পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকার কথা, স্কুলে যাওয়ার কথা, সেই বয়সে শিশুরা পরের বাড়িতে কাজ করছে।
আজকাল ভারি কাজেও শিশুদের লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। সমাজের কর্ণধাররা শিশুদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। সঠিক তদারকির অভাবে শিশুরা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
দেশে শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কোনো শিশুকে যেন অর্থের অভাবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করা না হয় সেজন্য সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাই বিপথগামী শিশুদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা সবার দায়িত্ব। সঠিক বয়সে শিশুকে স্কুলে পাঠাতে হবে। বর্তমানে সরকারি বিভিন্ন সহযোগিতায় দরিদ্র শ্রেনির শিশুদের শিক্ষার নানা ব্যবস্থা করা হয়েছে। উপবৃত্তির সুযোগ দেয়া হচ্ছে। তাই অভিভাবকদের অর্থনৈতিক দৈন্যদশা থাকা সত্ত্বেও শিশুদেরকে স্কুলে পাঠাতে হবে। অল্প বয়সেই শিশুরা যেন কুপথে না যেতে পারে সেজন্য পারিবারিক সচেতনতার বিকল্প নেই।
বাংলাদেশে ১৪ বছরের কম বয়সি শিশুদের কাজে নিয়োগ দেয়া আইনত নিষিদ্ধ। তবে সেই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবে প্রয়োগ হচ্ছে না। ফলে কমছে না শিশুশ্রম, যা শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ক্ষতিকর।
বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের অংশগ্রহণ কম নয়। ইউনিসেফ-এর হিসেবে দেশটিতে পাঁচ থেকে ১৪ বছর বয়সি শ্রমিকের সংখ্যা অন্তত ৪৭ লাখ। এদের মধ্যে প্রায় ১৩ লাখ শিশু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত।
জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে শিশুশ্রম বন্ধ করে সেসব শিশুকে লেখাপড়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া, তাদের লেখাপড়ায় উৎসাহিত করার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে, বিনিয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে শিশুদের উপর নির্ভরশীলদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত। লেখক: শিক্ষানবীশ সাংবাদিক, নিউজ নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ