October 31, 2024, 3:12 am
খেলার খবর: যেন জাদুর পরশে বদলে যাচ্ছে দেশের ফুটবলের চিত্র।’ তিলে তিলে গড়ে ওঠা দলটা এখন বিশ্ব ফুটবলে মাথাচাড়া দিচ্ছে। বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ কাতার বা শক্তিশালী ভারত ম্যাচে জামাল ভূঁইয়াদের লড়াকু ফুটবল ইঙ্গিত দিচ্ছে ইতিবাচক উন্নতির। ভুটান বিপর্যয়ের পর নির্বাসনে যাওয়া দেশের ফুটবলটা আলোর দিশা দেখেছে। একেবারে রাতারাতি বদলে যায়নি সবকিছু।আলোর দিশারীর মতো আবির্ভূত হয়ে যাদুর পরশে দেশের ফুটবলটাকে বদলে দিয়েছেন যিনি তার নাম জেমি ডে। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের প্রধান কোচ হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে বদলে যাওয়া গল্পটা লেখা হয়েছে এই ইংলিশ কোচের হাতে। দেড় বছরের সাধনার প্রতিফলন জামাল-রবিউলদের বর্তমান পারফরম্যান্স।এমন সময় জাতীয় দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন যেসময় দেশের ফুটবলের আকাশে কালো মেঘ জমে ছিল। ভুটানের কাছে হেরে আন্তর্জাতিক ফুটবলের বাইরে থাকা এই বাংলাদেশকে আলোর দিশা দেখিয়েছেন জেমি। ভুটান বিপর্যয়ের পর অ্যান্ড্রু ওর্ড নিয়েছিলেন জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব। ২০১৮ সালের জুন মাসে ওর্ড অব্যাহতি নিলে কোচ হিসেবে ওই মাসেই নিযুক্ত হন আর্সেনালের এই সাবেক ফুটবলার। প্রায় ১৫ মাস ধরে দায়িত্ব থেকেই অনেক চ্যালেঞ্জ নিতে হয়েছে তাকে।
যেভাবে বদলে দিলেন জেমি:
নতুন কোচ হিসেবে অনেক চ্যালেঞ্জ নিতে হয় একটা কোচকে। খেলোয়াড় বাছাই থেকে শুরু করে অনেক কর্মপরিকল্পনা নিতে হয় হাতে। চ্যালেঞ্জটা মোটেও সহজ ছিল না বাংলাদেশের সামনে। র্যাঙ্কিংয়ে ১৯৭তে দাঁড়িয়ে থাকা নড়বড়ে ফুটবলকে টেনে উপরে তোলা মোটেও সহজ ছিল না। সেই চ্যালেঞ্জটাই নিলেন জেমি ডে।এসেই চলমান প্রিমিয়ার লিগ থেকে বাছাই করে নিলেন অখ্যাত তারাদের। ‘অপেশাদার চাদরে পেশাদার লিগ’ থেকে সেই ফুটবলারদের সংগঠিত করে ‘একটা দল হিসেবে’ গড়ে তুলে আন্তর্জাতিক ফুটবলে নামানোর মতো করে বানিয়ে নেওয়াটাও ছিল বড় একটা চ্যালেঞ্জ।কোচ হিসেবে নিয়োগ পেয়েই প্রথম টার্গেট হিসেবে জানালেন র্যাঙ্কিংয়ের উন্নতি। সেটার জন্য চাই একটা ভালো দল গঠন। কাজটা দেশের ভঙুর অবস্থায় যে কঠিন সেটা জানতেন জেমি। দুই বছর পর দেশের মাটিতে আন্তর্জাতিক ফুটবলের কোন ম্যাচ হবে। তখন তারই প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল তাকে। বিপলু-জীবনদের-মতিন বেছে বেছে দলে অন্তর্ভুক্ত করলেন।কয়টা খেলোয়াড় বাছাই করে তো দল গড়াই যায়। কিন্তু সেই দলটাকে ভালো দল হিসেবে গড়ে তুলতে বেঁছে নিলেন পেশাদারিত্বকে। দলে যে সুযোগ পাওয়া একেবারে সহজ নয় সেই মানসিকতা গড়ে তোলা এ দেশে বড়ই কঠিন জেনে গেলেন দলের দায়িত্ব পেয়েই। ফুটবলারদের জীবনাচরণ যা আর দশজন সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা সেই মানসিকতাও গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ নিলেন জেমি।
পেশাদারিত্ব ও সুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি:
প্রথমে হাত দিলেন ফিটনেসে। ভাত খাওয়া কমিয়ে প্রোটিন-যুক্ত খাবারে অভ্যাসে আনার চ্যালেঞ্জ নিলেন জামাল ভূঁইয়াদের দিয়ে। ফিটনেসটাতে অতিরিক্ত মনোযোগ দিলেন তিনি। মাঠে যে বিপক্ষ দলের সঙ্গে ৯০ মিনিট একই দমে দৌড়াতে হবে বাংলাদেশের ফুটবলারদের! এই ফুটবলারদের খাদ্যাভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন আনলেন। বিশ্বমানের ফিটনেস করতে দেশের ফুটবলারদের একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনলেন এই ইংলিশ। দলে যুক্ত হলো পেশাদার ফিটনেস কোচ সিমন মল্টবাই। দলে সহকারী কোচ হিসেবে আরেক ইংলিশ কোচ স্টুয়ার্ট ওয়াটকিস। গোলরক্ষক কোচ হিসেবে আনা হলো ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে কাজ করা ববি মিমসকে। এরা সবাই ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে কোনও না কোন দলের সঙ্গে কাজ করেছেন।
ইপিএলে অভিজ্ঞদের নিয়ে শুরু হলো নতুন চ্যালেঞ্জ। মাঠে নামার চ্যালেঞ্জ। ফিটনেসের ঘাটতি পূরণ করে ইতিবাচক মানসিকতা তৈরি করতেও বড় চ্যালেঞ্জ নিতে হয়েছে এই দেড় বছরে। এখন হারার আগেই হেরে যায় না বাংলাদেশ। আর বিপলু-জামাল-সাদদের এখন মেদহীন ঝরঝরা সিক্স-এইট প্যাক শরীর বানানোর পেছনে বড় অবদান জেমির।ফিটনেস আর মানসিকতা উন্নত করে এখন জেমি হাত দিলেন পেশাদারিত্বের দিকে। একজন ফুটবলার বড় ফুটবলার তৈরি হয় পেশাদারিত্বের মাধ্যমে। সেই মানসিকতাও দেশের ফুটবলারদের মনে গেঁথে দিয়েছেন এই ইংলিশ কোচ। প্রতিযোগিতার মনোভাবটা সবার মনে ঢুকে দিতে পেরেছেন তিনি। এখন তাই দলে চাইলেই ঢোকা ‘হাতের মোয়া’ নয় এটা বুঝে গেছেন প্রিমিয়ার লিগের ফুটবলাররা। জাতীয় দলে এখন একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা গড়ে তুলেছেন জেমি।এটা তো হলো। এরপর মাঠে নামার পালা। তবে এসেই সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে জেমিকে। সদ্য গড়া দলটা যে প্রথম ম্যাচেই লঙ্কানদের কাছে হেরে গেছে। একজন নতুন কোচের এমন সমস্যা হয়। কোচের দর্শনটা মাঠে ফলাতে একটু সময় লাগে। সাফল্য পেতেও সময় নেয়নি জেমি। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে দারুণ ফুটবল উপহার দিয়েছে বাংলাদেশ তারই হাত ধরে। পাকিস্তান-ভুটানকে হারিয়েও দুর্ভাগ্যের কারণে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। এরপর বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপেও সেমি ফাইনালে যাওয়ার পথে লাওসকে হারিয়েছে। ফিলিপাইন ও প্যালেস্টাইনের কাছে খুবই কম মার্জিন ব্যবধানে হেরেছে বাংলাদেশ। এরপর প্রীতি ম্যাচে কম্বোডিয়াকে হারিয়েছে তাদের মাটিতে গিয়ে।
বিশ্বকাপ বাছাইয়ের চ্যালেঞ্জ :
এবার বিশ্বকাপ প্রাক-বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপ বাছাইয়ের দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে প্রাক-বাছাই বাধা পেরুতে হবে। এটাই জেমির সামনে ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জটা দারুণভাবে পেরিয়ে গেছে জেমির লাল-সবুজ বাহিনী। লাওসের মাঠে জয় নিয়ে এক প্রকার নিশ্চিত করে ফেলেছে দ্বিতীয় রাউন্ড। দেশের মাটিতে লাওস যেন খেই খেয়েছে জামাল ভূঁইয়াদের হাতে।এর মাঝে প্রীতি ম্যাচগুলো ধারাবাহিকভাবে জয় পেতে থাকে বাংলাদেশ। প্রাক-বাছাইসহ ১২ ম্যাচে ৭ জয় তুলে নিয়েছে জেমির দল। চারটি হার আর একটি ড্র ছিল ধারাবাহিক ভালো পারফরম্যান্সের প্রমাণ। প্রায় ৫৮ শতাংশ জয়ের রেকর্ড তারই বড় প্রমাণ। সেটাতে ভালোভাবে উতরে গেছে জেমি ডে।এর মাঝেই এমন সাফল্যে চুক্তি বাড়ানো হলো জেমির। আরও এক বছর পাচ্ছেন এই ইংলিশ কোচ। এখন দায়িত্ব ছিল দর্শন আর কৌশলে একটা জুতসই দল গঠন। সেটাতেও সফল তিনি। জাতীয় দলের রক্ষণটাকে শক্ত করে কাউন্টার অ্যাটাক ফুটবল দর্শনে নেমে পড়লেন জেমি। তরুণ আর অভিজ্ঞতার মিশেলে দলটা সেই দর্শনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তাইতো কাতারের মতো দেশকেও ঘরের মাঠে একেবারে নাস্তানুবাদ করে ছেড়েছে বাংলাদেশ। শুধু গোলটাই যেন পাওয়া হয়নি। এরপর ভারতের সঙ্গে কলকাতার ৮০ হাজার দর্শকের সামনে যে ফুটবল খেলেছে বাংলাদেশ সেটা সম্ভবত পুরো কোটি দর্শক দেখেছেন। মোহিত হয়েছে। ভারতকে না হারাতে পারার যন্ত্রণা অনেকের বুকে এখনও বেঁধে আছে।এর মাঝেও দারুণ একটা সাফল্য নিয়ে ফিরেছেন জেমি। এশিয়ান গেমসে তার নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো নক আউট পর্বে গিয়েছে বাংলাদেশ তার হাত ধরেই। এই মিশনে থাইল্যান্ডকে রুখে দিয়ে কাতারকেও হারিয়েছিল বাংলাদেশ।এসব সাফল্যগাঁথাতো আছেই। সঙ্গে এখন আরও বড় চ্যালেঞ্জ নিতে হচ্ছে জেমিকে। সামনে আরও পাঁচটি ম্যাচ পাচ্ছে বাংলাদেশ বিশ্বকাপের বাছাইয়ে। ঘরের মাঠে পাচ্ছে তিনটি। এই ম্যাচগুলোতে সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স ধরে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ জেমির সামনে। অবশ্য নিজেদের ঝালিয়ে নেয়ার সুযোগও পাবেন জেমি। সামনে সাফ ও বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের মতো বড় দুটো টুর্নামেন্টও পাচ্ছেন এই মাস্টার মাইন্ড।সবমিলে আসলে কি পরিবর্তন আনলেন জেমি ডে? কী মনে হয় আপনাদের। জেমির কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস, ‘বাংলাদেশের ফুটবলারদের পেশাদারিত্বের মনোভাবটা আনাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল আমার। সেটাতে সফল হয়েছি। এখন ধারাবাহিকতা বজায় রেখে পারফরম্যান্সে সাফল্য পাওয়াটাই বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জে প্রস্তুত আমার ছেলেরা।’দেশের ফুটবল ইতিহাসে কোচ আসা যাওয়ার সংস্কৃতিতে জেমিই অনেকদিন ধরে কোচের দায়িত্বে। তার কাঁধে ভর করে আরও এগিয়ে যাক এমনটাই প্রত্যাশা দেশের ফুটবল সমর্থকদের।