প্রথম প্রেমের কথা মনে করলে আজও মনে কেমন শিরশিরানি অনুভূত হয়। হ্যা, প্রথম প্রেমে পরেছিলাম ক্লাস এইটে পড়া কালীন। সেই প্রেমের রেশ আজও আমার মনে গেঁথে রয়েছে। তবে তখন যে অনুভূতি হতো তাকে নিয়ে, এখন না দেখতে দেখতে অনেকটাই তা ফিকে হয়ে গেছে। তবুও কখনো কখনো দেখলে এখনো মুখে আমার কোলগেটের হাসি খেলে যায়।তখন তার মুখ দেখে সকালে ওঠা থেকে শুরু করে দিনের শেষে তার মুখ দেখে ঘুমের দেশে যাওয়া অবধি প্রতিটি মূহুর্তে তার উপস্থিতি কামনা করতাম কল্পনায়। আবার এও জানতাম, তাকে কখনোই আপন করে পাবোনা।পাওয়ার সদিচ্ছা থাকলেও, পরিস্থিতি তার একেবারেই বিপরীত। বয়সে সে আমার থেকে মোটামুটি তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের বড়ো। আরো বেশি হতে পারে। কখনো কাউকে জিজ্ঞেস করবার সাহস পাইনি। এছাড়াও তিনি তখনই ছিলেন এক কন্যার পিতাসহ সফল সংসারী মানুষ। তবুও বয়সের আকাক্সক্ষা আমাকে এতটাই গভীর চিন্তায় ফেলতো, মাঝে মাঝে মনে হতো, একবার যদি কাছে গিয়ে বলতে পারতাম তাকে!কো-এডুকেশন স্কুলে পড়ার দরুণ, অনেক ছেলেই প্রস্তাব দিতো, ‘ফড় ুড়ঁ ষড়াব সব, ও ষড়াব ুড়ঁ’। আসলে বাম সরকার সরকারি স্কুলে ক্লাস ওয়ানে ইংরেজি তুলে দেওয়ার জন্য, আমদের সময় অ, ই, ঈ, উ, শেখানো হতো ক্লাস ফাইভে উঠলে। এর মধ্যে যারা যারা বাড়িতে আগের থেকে ও বিষয়ে একটু চর্চার মধ্যে থাকতো, তাদের কাছে মোটামুটি বেশি সময় লাগতো না ও বয়সে অ-অঢ়ঢ়ষব, ই- ইধষষ শিখতে। কিন্তু যারা একেবারেই ওই অক্ষরগুলো প্রথম দেখে ক্লাস ফাইভে তারা তখন মোটামুটি দু-তিন বছর লাগিয়ে দিত সেগুলো ভালোভাবে শিখতে। তাই ওই একটি বিষয়ে পন্ডিত হওয়ার ইচ্ছায় কিছু পেছনের বেঞ্চের পন্ডিতগন এক একটি ক্লাসে দু-তিন বছর মোটামুটি থাকতো।ও সঙ্গে আর একটি বিষয়ে, পরের ক্লাস থেকে কতজন নতুন মেয়ে তাদের ক্লাসে উঠবে সে বিষয়ে হিসেব নিকেশ করতে গিয়ে বইয়ের অঙ্কের হিসেবেও গরমিল হতো, তাই ও বিষয়টি ভালোভাবে আয়ত্ত করার সংকল্প থাকতো পন্ডিতদের। তাই এই দু’বিষয়ে পান্ডিত্য পাওয়ার আশায় ক্লাসে থাকতে থাকতে গোঁফ দাড়ি বেড়িয়ে যেতো। আমাদের একজন স্যার ছিলেন, যিনি ক্লাসে এসে প্রতিদিনই প্রায় বলতেন, ‘হ্যাঁ রে তোরা স্কুলকে এত ভালোবাসিস, যে স্কুল ছাড়তেই চাস না’। তারা তখন স্কুলের প্রতি ভালোবাসার কথা শুনে হাসতে হাসতে বেঞ্চে লুটিয়ে পড়ে যেত। তবুও মেয়েদের কাছে প্রেম নিবেদনে একটি বাক্যের বেশি আর কিছু শেখা হয়ে উঠতো না তাদের পুরো স্কুল জীবনে।আমার ওই কথাটি শুনলে আরো যেতো তখন মাথা গরম হয়ে।তোদের কি আর কোন ভাষা নেই প্রেম নিবেদনে? আমার স্বপ্নের নায়ক তখন কি সুন্দর কথা বলতো তার বিপরীত মানুষটির সঙ্গে। একটু তুতলিয়ে, তাতে কি; সঙ্গে আবার হাতও নাড়াতো। তা দেখেই আমি ফিদা। একদিন তাই প্রিয় বন্ধু পূর্ণিমার সঙ্গে প¬্যান করলাম, ‘চ, প্রস্তাবে সাড়া দেব একজনের। কারণ তাকে আমার নায়কের একটি ছবি জোগাড় করে দিতে বলবো’। যেই বলা সেই কাজ। একটি ছবি আমার হাতে এলো দু-একদিন পর।ছবিটি নিয়ে ব্যাস, আমার বাংলা বইয়ের পাতার ভাজে। কাউকে বলার সাহস নেই। জানি মার খেতে হবে, যে কোন খবর নিতে গেলে। তার থেকে তার ছবি দেখেই তাকে প্রথম প্রেম নিবেদন। আর তাকে একবার দেখতে গিয়ে তো বাড়ির স্যারের কাছে এমন মার খেলাম যে নতুন পরা সখের শাঁখার আংটি ভেঙে হাতে ফুটে রক্তারক্তি। পরদিন মনের দুঃখে তাকে একটি চিঠি লিখলাম আর তা ব্যাগের মধ্যেই রেখে দিলাম। ডিজাইন করে লাল রঙের গোল টিপকে ভালোবাসার আকৃতি দিয়ে তাতে বসালাম।দিদা রোজ ব্যাগ চেক করতো, আর পর তো পর দিদার হাতে। ভাগ্যিস নতুন শেখা প্যাঁচানো হাতের লেখায় লিখেছিলাম। তাই পুরোটা উদ্ধার করতে না পাওয়ার জন্য আর নামের প্রয়োগ ছিল না বলে এট্টু কম মার খেতে হয়েছিল। তখন আবার ভাবছিলাম, কেন যে ভালোবাসার প্রতিকি চিহ্নটি লাগাতে গেলাম!তাই মাধ্যমিক পাশ করে ভর্তি হলাম যোগমায়া দেবী কলেজে। যদি একবার চোখের দেখা দেখতে পাই। বাড়ির সবাই আপত্তি করেছিল, ভোরবেলা দুটো বাস পাল্টে কলেজ! তাতে কী? আমার লক্ষ্য যে একমাত্র তার দর্শন। কলেজে গিয়েও কত চেষ্টা করেছি জানার, তার বাড়ির ঠিকানা। যদিও বেশি কাউকে বলতে লজ্জাই পেতাম। কে কি ভাববে! পুজোর সময় তার বাড়িতে পুজো হতো শুনে কতবার যাওয়ার চেষ্টা করেছি, কাউকে বললেই নাক সিটকানো, ‘কলকাতায় এত বড়ো বড়ো পুজো হয়, শেষে কিনা ওখানে’। তবুও ভয়ে বলতেই পারিনি আমি তাকে খুব ভালোবাসি।শেষে জীবনে এসে গেল খলনায়ক (এখন বর)। তখন আবার ভয়, জানতে পারলেই সে বড়ো দুঃখ পাবে। তাই তাকেও আর বলা হয়ে ওঠেনি।মেয়ে হতে তাকেও ভর্তি করলাম ওই অঞ্চলের একটি স্কুলে। মেয়ে সামনের বছর মাধ্যমিক দেবে।আজও আমার প্রথম প্রেমকে চোখের দেখা দেখতে পারিনি। আর হবে বলে মনে ও হয়না। একদিন মেয়ের সঙ্গে গল্প করতে করতে তাকে বলায়, সে এমন ভাবে আৎকে উঠে আমার দিকে তাকালো যেন, আমি মিসাইল ফেললাম তার পায়ের কাছে।তাই সেও বুঝলোনা আমার ভালোবাসার অনুভূতি।এখন তো তার মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে। বয়স বেড়েছে অনেক। আবার শুনেছি মেয়ের ছাড়াছাড়ি ও হয়ে যাবে। আহা ! কত কষ্ট পেয়েছে আমার প্রথম প্রেম। মনে বড়ো বেদনা হয় আজও। কখনো তাকে আমার মনের কথা বলা তো দূর, চোখের দেখাও দেখতে পারিনি বলে। সবাই বলে প্রথম প্রেম ভোলার নয়, আমার ক্ষেত্রেও তাই। বিয়ের পর তার ছবিটাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে সেই যে আলমিরার চোরা কুঠুরিতে ঢুকিয়ে রেখেছিলাম, আজও সেখানেই সে রয়ে গেছে।যাক ! আর দুঃখের কথা আর শুনিয়ে লাভ নেই। এখন একান্ত অবসরে তাকে মনে করে মাঝে-সাঝে গেয়ে যাই নচিকেতার সেই গান,‘সে প্রথম প্রেম আমার, রঞ্জিত মলি¬ক’
যেখানেই আপনি থাকবেন, ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন।ধন্যবাদ সকলকে, এত কষ্ট করে পড়ে আমার ভালোবাসার কথা জানলেন। শুধু একটা অনুরোধ কেউ প্যাক দেবেন না পি¬জ।