November 21, 2024, 11:25 am
আজ রবিবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। সকাল ৮টায় থেকে বিরতিহীনভাবে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলবে। বিএনপি-জামায়াত ও তাদের সমমনা দলগুলোর বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতিই বড় চ্যালেঞ্জ। ভোটার উপস্থিতির উপর নির্বাচনী ফলাফলে বহিঃবিশ্বের স্বীকৃতির বিষয়টি নির্ভর করছে। যদি ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে নির্বাচন কমিশন (ইসি), প্রশাসন ও মতাসীন দল আওয়ামী লীগের প থেকে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভোটার উপস্থিতির পাশাপাশি ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিয়ে আশংকা রয়েছে। বিভিন্ন মহল থেকে বড় ধরণের নাশকতার আশংকা করা হচ্ছে। তাই যে কোনধরণের অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি এড়াতে সারাদেশে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে শুরু থেকে নানামূখী উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিলো। কারণ বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে আন্দোলন করছে বিএনপিসহ বেশ কিছু দল। আর সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকার অধীনে নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে শুরু থেকেই অনড় ছিল আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রশ্নে তৎপর ছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ। সরকারের ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টির চেষ্টাও ছিল তাদের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাংবিধানিক নির্দেশনা অনুসরণ করে গত ১৫ নভেম্বর নির্বাচনী তফশিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। দাবি পূরণ না হওয়ায় নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি, বাম গণতান্ত্রিক জোট, ইসলামী আন্দোলনসহ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ১৬টি রাজনৈতিক দল। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়ে মিছিল-সমাবেশ ও অসহযোগ কর্মসূচী পালন করেছে। শনিবার সকাল থেকে ৪৮ ঘণ্টার হরতাল পালন করছে। নির্বাচনী তফশিল অনুযায়ী, ইসি ভোটগ্রহণের সকল আয়োজন সম্পন্ন করলেও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কমেনি। নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণায় বড়ধরণের কোন সহিংসতা না ঘটলেও শুক্রবার রাতে রাজধানীর গোপীবাগে ট্রেনে অগ্নিসংযোগ ও সারাদেশে নাশকতায় উৎকণ্ঠা বেড়েছে। এ নিয়ে জনমনে আতংক দেখা দিয়েছে। গত শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় ১৪টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এতে ৫ জন নিহত ও অন্ততঃ ৩০ জন আহত হয়েছে। ওই সকল ঘটনায় ছয়টি যানবাহন ও নয়টি স্থাপনা তিগ্রস্ত হয়েছে। স্কুল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ভোটকেন্দ্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই অবস্থায় কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে আরো বেশি বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে ইসি। এই অবস্থায় দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের সামনে সংসদ নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি ও ইসি’র প্রস্তুতি বিস্তারিত তুলে ধরেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। গতকাল শনিবার বিকেলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, একটি পরে ভোট বর্জনের কারণে সংসদ নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানে সংকট দেখা দিতে পারে। কারণ ট্রেনে আগুন দেওয়া হয়েছে। ভোটকেন্দ্রেও আগুন দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। কোন দল যদি এটি করে থাকে, এটি অমার্জনীয় অপরাধ বলে মনে করি। তিনি আরো বলেন, যারা হরতাল দিয়েছে, তারাও বলেছিলো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করবে। আমরা বিশ্বাস করেছিলাম শান্তিপূর্ণভাবে ভোটারদের মাঝে (তারা) ভোটবিরোধী প্রচারণা চালাবে। নির্বাচনে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল আসেনি এবং ইভিএম ও সিসিটিভি চেয়েও পাওয়া যায়নি, এ অবস্থায় নির্বাচনকে কতটা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন, এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘কতটা নিয়ন্ত্রিত হবে সেটা ভবিষ্যৎ বলবে। সর্বাত্মক চেষ্টা হচ্ছে। সকল প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তবে কোন একটা বিরোধী প ভোট বর্জনের পাশাপাশি প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। এতে নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে উঠিয়ে আনারেে ত্র কিছুটা সংকট দেখা দিতে পারে। এই বাস্তবতাটা অস্বীকার করছি না। তবে আশা করি, বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও পরিস্থিতি মোকাবিলা করে জনগণের অংশগ্রহণে ও ভোটরদের আগমণে (নির্বাচন) নির্বাচন উৎসবমুখর হয়ে উঠবে। এবারের নির্বাচনে প্রায় ১২ কোটি ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে ৫ বছরের জন্য তাদের আইনপ্রণেতা নির্বাচিত করবেন। ইসিতে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৮টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশ নিচ্ছে। নওগাঁ-২ আসনের এক প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে ২৯৯ আসনে ভোট গ্রহণ করা হবে। নির্বাচনী লড়াইয়ে রয়েছেন এক হাজার ৯৭০ জন প্রার্থী। তাদের মধ্যে এক হাজার ৫৩৪ জন রাজনৈতিক দলের মনোনীত ও বাকি ৪৩৬ জন স্বতন্ত্র। এরমধ্যে আওয়ামী লীগের ২৬৬ জন, জাতীয় পাটির ২৬৫ জন ও তৃণমূল বিএনপির ১৩৫ জন প্রার্থী রয়েছে। এবারই প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন। নারী প্রার্থী আছেন ৯৭ জন। এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। এরমধ্যে ৬ কোটি ৭ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৯ জন পুরুষ ও ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার ২০২ জন নারী। এ ছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের ৮৫২জন ভোটার রয়েছেন। আর প্রথমবারের মতো ভোট দিবে এক কোটি ৫৪ লাখ ৫২ হাজার ভোটার। নির্বাচনে ৪২ হাজার ১০৩টি কেন্দ্রের ২ লাখ ৬১ হাজার ৯১২টি কে ভোটগ্রহণ করা হবে। সব আসনেই সনাতন পদ্ধতিতে ব্যালট পেপার ব্যবহার করে ভোটগ্রহণ চলবে। কারচুপি এড়াতে আজ রবিবার সকালে ৯৩ শতাংশ কেন্দ্রে, অর্থাৎ ৩৯ হাজার ৬১টি কেন্দ্রে ব্যালট পেপার যাবে। দুর্গম এলাকাগুলোতে ইতোমধ্যে ব্যালট পেপার পৌছেছে। ভোটগ্রহণে দায়িত্ব পালন করবেন (প্রিসাইডিং অফিসার প্রতি কেন্দ্রের জন্য একজন, প্রতিটি ভোটকে একজন সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও কে ২ জন পোলিং অফিসার) ৮ লাখ কর্মকর্তা। এরমধ্যে প্রিসাইডিং অফিসার ৪৮ হাজার ১৪৮জন, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ২ লাখ ৬১ হাজার ৫৬৪ জন এবং পোলিং অফিসার ৫ লাখ ২৩ হাজার ১২৮ জন। এর বাইরে ৬৬ জন রিটানিং কর্মকর্তা ও ৫৯২ জন সহকারি রিটার্ণিং কর্মকর্তা রয়েছেন। নির্ধারিত সময়ে ভোটগ্রহণ শেষে ভোটগণণা শুরু হবে। ভোট গণনার কাজ শেষ হওয়ার পর পরই প্রত্যেক প্রিজাইডিং অফিসার ব্যবহƒত ব্যালট পেপার ভর্তি সিলমোহরকৃত বিভিন্ন ধরনের প্যাকেট, ভোট গণনার বিবরণী ও ব্যালট পেপারের হিসাব সরাসরি অথবা সহকারি রিটার্ণিং অফিসারের মাধ্যমে রিটার্ণিং অফিসারের কাছে পাঠাবেন। তিনি প্রিজাইডিং অফিসারদের কাছ থেকে প্রাপ্ত ফলাফল যোগ করে প্রত্যেক প্রার্থীর ফলাফল নির্ধারণ করবেন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন দেখার জন্য প্রায় ২০০ জন পর্যবেক অনুমোদন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ ছাড়া নির্বাচন পর্যবেণে দেশি ২০ হাজার ৭৭৩ জন পর্যবেককে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে ৪০টি পর্যবেক সংস্থার ৫১৭ জন এবং স্থানীয়ভাবে ৮৪টি পর্যবেণ সংস্থার ২০ হাজার ২৫৬ জন ভোট পর্যবেণ করবে। বিদেশ থেকে সাংবাদিক এসেছেন ৯২ জন। এছাড়া দেশের ১০ হাজারের বেশি সাংবাদিককে নির্বাচনী সংবাদ সংগ্রহের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ভোটকে ঘিরে সারাদেশে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। হরতাল ঘিরে যে কোনো ধরণের নাশকতা প্রতিরোধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যসহ সাতটি বাহিনীর প্রায় ৮ লাখ সদস্য ভোটের মাঠে দায়িত্ব পালন করছে। এসব বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে র্যাব ৫ হাজার ৫৬০ জন, বিজিবি ৪৪ হাজার ৯১২ জন, পুলিশ এক লাখ ৭৪ হাজার ৭৬৭ জন, আনসার ৫ লাখ ১৪ হাজার ২৮৮ জন, সেনাবাহিনীর ৩৮ হাজার ১৫৪ জন, কোস্টগার্ড ২ হাজার ৩৫৫ জন এবং নৌবাহিনীর ২ হাজার ৮২৭ জন। এর বাইরে প্রায় তিন হাজার বিচারিক ও নিবার্হী হাকিম রয়েছেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যয় দেড় হাজার কোটি টাকা ধরা হলেও তা আড়াই হাজার কোটি টাকায় পৌছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আসনপ্রতি সাত কোটি টাকার বেশি ব্যয় হবে। এ ব্যয়ের তিন ভাগের দুই ভাগ রাখা হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রায়। ইতোমধ্যে দুই হাজার ৩০০ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে। ভোটার, প্রার্থী ও নাগরিকদের বিভিন্ন তথ্যের নিশ্চয়তা দিতে ‘স্মার্ট ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট বিডি’ নামের একটি অ্যাপ চালু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এই অ্যাপে ভোটার নম্বর, কেন্দ্রের নাম ও লোকেশন, ভোট পড়ার হার, প্রার্থীদের হলফনামাসহ নির্বাচনের বিভিন্ন তুলনামূলক চিত্র ঘরে বসেই যে কেউ জেনে নিতে পারবেন। অ্যাপে কেন্দ্রভিত্তিক দুই ঘণ্টা পরপর ভোট পড়ার হার জানা যাবে। ভোটকেন্দ্রের তথ্য এখনই জানতে পারছেন, যেকোনো ভোটারের ভোটকেন্দ্র কোনটি এবং লোকেশন কোথায় জানা যাচ্ছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলে ৭২ ঘণ্টা মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও এবারই প্রথম গণপরিবহন চালু রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে ২৪ ঘণ্টার জন্য ট্রাক, পিকআপ, মাইক্রোবাস ও ট্র্যাক্সি ক্যাব চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তবে এসময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী, প্রশাসনের সদস্য ও অনুমোদিত পর্যবেক, জরুরি সেবার যানবাহন, ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও অভিন্ন কাজে ব্যবহƒত জিনিসপত্র এবং সংবাদপত্র বহনকারী সব ধরনের যানবাহন, দূরপাল্লার যানবাহন, প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী ও তাদের এজেন্টদেরেে ত্র এই বিধিনিষেধ শিথিল করা হবে। সাংবাদিক, পর্যবেক, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী, জাতীয় মহাসড়ক, প্রধান আন্তঃজেলা রুট, মহাসড়ক এবং প্রধান মহাসড়কের সংযোগ সড়কেরেে ত্রও বিধিনিষেধ শিথিল করা হবে। উল্লেখ্য, গত ১৫ নভেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন সিইসি। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার শেষে ১৮ ডিসেম্বর চূড়ান্ত প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ দেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তারা। ওই দিন থেকেই আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হয়।