November 21, 2024, 8:37 am
বহুল আকাক্সিক্ষত স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের আগ মুহূর্তে গতকাল শনিবার মাওয়া প্রান্তের সুধী সমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে গভীর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের মানুষ আজ গর্বিত। সেই সঙ্গে আমিও আনন্দিত, গর্বিত ও উদ্বেলিত। অনেক বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে, ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে, আজ আমরা এ পদ্মা সেতু নির্মাণে সক্ষম হয়েছি। এ সেতু শুধু একটি সেতু নয়, এ সেতু যে দুই পাড়ের বন্ধন সৃষ্টি করেছে শুধু তাই নয়, এ সেতু শুধু ইট-সিমেন্ট-স্টিল-লোহার কংক্রিটের একটি অবকাঠামো নয়, এ সেতু আমাদের অহংকার, গর্ব, সক্ষমতা আর মর্যাদার প্রতীক। শেখ হাসিনা বলেন, পদ্মাার বুকে আজ জ¦লে উঠেছে লাল, নীল, সবুজ, সোনালি আলোর ঝলকানি। ৪১টি স্প্যান যেন স্পর্ধিত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। তিনি বলেন, এ সেতু বাংলাদেশের জনগণের। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির আবেগ, সৃজনশীলতা, সাহসিকতা, সহনশীলতা আর প্রত্যয় এবং এই জেদ যে, পদ্মা সেতু আমরা তৈরি করবোই। যদিও ষড়যন্ত্রের কারণে এ সেতু নির্মাণ দুই বছর বিলম্বিত হয়। কিন্তু আমরা কখনো হতোদ্যম হইনি, হতাশায় ভুগিনি। আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে চলেছি এবং শেষ পর্যন্ত সব অন্ধকার ভেদ করে আলোর পথে যাত্রা করতে সক্ষম হয়েছি। জাতির পিতার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের সেই অমোঘ মন্ত্র ‘কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না’ পুনরুল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি, আমরা বিজয়ী হয়েছি। তারুণ্যের কবি সুকান্তের ভাষায় তিনি বলেন, ‘সাবাস, বাংলাদেশ। এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়/জ¦লে পুড়ে-মরে ছারখার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়। আমরা মাথা নোয়াইনি। কোনোদিন মাথা নোয়াবো না, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও কখনো মাথা নোয়াননি। তিনি আমাদের মাথা নোয়াতে শেখাননি, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও তিনি জীবনের জয়গান গেয়েছেন। তিনি বাংলার মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতা চেয়েছিলেন এবং তারই নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই তার এবং তার সরকারের পথচলা উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই আজ বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণকাজের গুণগত মান নিয়ে কোনো আপোশ করা হয়নি। এ সেতু নির্মিত হয়েছে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও উপকরণ দিয়ে, সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা বজায় রেখে। পুরো নির্মাণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে সর্বোচ্চ মান বজায় রেখে। পদ্মা সেতুর পাইল বা মাটির গভীরে বসানো ভিত্তি এখন পর্যন্ত বিশ্বে গভীরতম। সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীর পর্যন্ত এ সেতুর পাইল বসানো হয়েছে। ভূমিকম্প প্রতিরোধ বিবেচনায় ব্যবহৃত হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। এ রকম আরও বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে এ সেতুর নির্মাণ পদ্ধতি বিশ্বজুড়ে প্রকৌশলবিদ্যার পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত হবে বলে আমি আশা করি। কারণ এটা একটি আশ্চর্য সৃষ্টি। তিনি বলেন, এ বিশাল কর্মযজ্ঞ থেকে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পেরেছেন আমাদের প্রকৌশলীরা। ভবিষ্যতে নিজেরাই এ ধরনের জটিল সেতু বা অবকাঠামো নির্মাণ করতে সক্ষম হবো আমরা। সেতু নির্মাণ যেমন কঠিন ছিল, তেমনি আঁকাবাঁকা, খর¯্রােতা উন্মত্ত পদ্মা নদীকে শাসনে রাখাটাও একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল। সেই চ্যালেঞ্জও সফলভাবে মোকাবিলা করে নদীর দুই পাড়কে সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেতুর উভয় দিকে রয়েছে উন্নত ব্যবস্থাপনাসমৃদ্ধ ও দৃষ্টিনন্দন সার্ভিস এরিয়া। সরকারপ্রধান বলেন, ‘প্রকল্প এলাকায় পরিবেশ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের আওতায় বনায়ন কর্মসূচির পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যের ইতিহাস ও নমুনা সংরক্ষণের জন্য জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। বহুমুখী এ সেতুর ওপরের ডেক দিয়ে যানবাহন এবং নিচের ডেক দিয়ে চলাচল করবে ট্রেন। সেতু চালু হওয়ার পর সড়ক ও রেলপথে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। ফলে এ অঞ্চলের মানুষের একদিকে দীর্ঘদিনের ভোগান্তি লাঘব হবে, অন্যদিকে অর্থনীতি হবে বেগবান। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হবে। আশা করা হচ্ছে, এ সেতু জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ১ দশমিক দুই-তিন শতাংশের বেশি হারে অবদান রাখবে। এর ফলে দারিদ্র্য নিরসন হবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, ‘এ সেতুকে ঘিরে গড়ে উঠবে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্ক। ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে এবং দেশের শিল্পায়নের গতি ত্বরান্বিত হবে। পদ্মা সেতু এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযোগের একটা বড় লিংক। তাই আঞ্চলিক বাণিজ্যে এ সেতুর ভূমিকা অপরিসীম। তাছাড়া পদ্মার দুপাড়ে পর্যটনশিল্পেরও ব্যাপক প্রসার ঘটবে। পাশাপাশি এ বছরের শেষ নাগাদ চালু হবে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল এবং ঢাকায় মেট্রোরেল। ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদন শুরু হবে। ঢাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। সেটিও ২০২৩ নাগাদ চালু হবে। প্রধানমন্ত্রী এ সময় দেশের একজন স্বনামধন্য ব্যক্তির ষড়যন্ত্রে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধে বিশ্বব্যাংকের পদক্ষেপ এবং তাকে, তার পরিবারের সদস্য এবং মন্ত্রিপরিষদ ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ দেওয়ার অপচেষ্টাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তা মোকাবিলার ইতিবৃত্তও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এ সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা পর্যায়ে চক্রান্তকারীদের মিথ্যা ষড়যন্ত্রের কারণে আমার পরিবারের সদস্য ছোটবোন শেখ রেহানা, আমার দুই সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সায়মা ওয়াজেদ, রেহানার পুত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক, আমার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক যোগাযোগ সচিব মোশাররফ হোসেন ভুইয়াসহ কয়েকজন সহকর্মী চরম মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়েছিলেন। আমি তাদের প্রতি সহমর্মিতা জানাচ্ছি। শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মা, বাবা, ভাইসহ পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে হারিয়ে ছয় বছর রিফিউজি হিসেবে জীবন কাটিয়েছি। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আমাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করলে একরকম জোর করে দেশে ফিরে আসি। তখন এ জনগণই আমাকে আপন করে নেন। আমি যখন জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন, তখনো এ জনগণই এগিয়ে আসে। তাকে সাহস ও শক্তি জোগায়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ জনগণই আমার সাহসের ঠিকানা, এ জনগণকে আমি স্যালুট জানাই। পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে বলে আশা করি। তাদের হয়তো চিন্তা-চেতনার দৈন্যতা রয়েছে। আত্মবিশ্বাসের অভাব রয়েছে। আশা করি, আগামীতে তাদের দেশপ্রেম জাগ্রত হবে ও দেশের মানুষের প্রতি তারা আরও দায়িত্বশীল হবেন। প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজের সঙ্গে জড়িত অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীসহ যারা মৃত্যুবরণ করছেন, তাদের রুহের মাগফিরাত এবং আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। তিনি এ সেতু নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা-কর্মচারী, দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ পরার্শক, ঠিকাদার, প্রকৌশলী, প্রযুক্তিবিদ, শ্রমিক, নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি দেশবাসীর প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম পদ্মা সেতুর নির্মাণবিষয়ক সূচনা বক্তৃতা করেন। তিনি প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম, উপ-পরিচালক কামরুজ্জামান, প্রজেক্ট ম্যানেজার অ্যান্ড সুপারভিশন কনসালটেন্ট রবার্ট জন এভিসসহ প্রকল্প বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজনকে পরিচয় করিয়ে দেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে শিল্পকলা একাডেমি নির্মিত দেশবরেণ্য শিল্পীদের অংশগ্রহণে থিম সং পরিবেশিত হয়। অনুষ্ঠানে পদ্মা সেতুর ওপর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকিট, স্যুভেনির শিট, উদ্বোধনী খাম ও সিলমোহর এবং ১০০ টাকা মূল্যের স্মারক নোট অবমুক্ত করেন। পদ্মা সেতুর নির্মাণকারী কোম্পানির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে পদ্মা সেতুর একটি রেপ্লিকা উপহার দেওয়া হয়। নির্মাণ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ফটোসেশনেও অংশগ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। এরপর প্রধানমন্ত্রী প্রথম ব্যক্তি হিসেবে টোল দিয়ে সেতুর মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-১ উন্মোচন করেন এবং মোনাজাতে অংশ নেন। প্রধানমন্ত্রীর কন্যা এবং বাংলাদেশের অটিজম আন্দোলনের পথিকৃৎ সায়মা ওয়াজেদ এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তার গাড়িবহর নিয়ে সেতু অতিক্রমের সময় মাঝ বরাবর নেমে সেতু এবং প্রমত্তা পদ্মার উত্তাল তরঙ্গ প্রত্যক্ষ করেন। এ সময় তিনি বিমানবাহিনীর একটি মনোজ্ঞ ডিসপ্লে উপভোগ করেন। প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু পার হয়ে জাজিরা প্রান্তে উপস্থিত হন এবং সেতুর উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-২ উন্মোচন করেন ও মোনাজাতে অংশ নেন। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়িতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী।