November 21, 2024, 8:39 am

সাংবাদিক আবশ্যক
সাতক্ষীরা প্রবাহে সংবাদ পাঠানোর ইমেইল: 1linenewsagency@gmail.com
কক্সবাজারে ‘ধর্ষণের’ ঘটনা প্রকাশ হলো যেভাবে

কক্সবাজারে ‘ধর্ষণের’ ঘটনা প্রকাশ হলো যেভাবে

ঢাকা থেকে কক্সবাজার বেড়াতে গিয়ে এক গৃহবধূর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়ার অভিযোগ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এ ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত চার যুবকের মধ্যে তিনজনকে শনাক্ত করার কথা জানিয়েছে র‌্যাব। আটক করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট হোটেলের ম্যানেজারকে। ওই নারীর ভাষ্য অনুযায়ী, স্বামী-সন্তান নিয়ে বুধবার সকালে তারা কক্সবাজার পৌঁছান। এরপর শহরের হলিডে মোড়ের একটি হোটেলের কক্ষ ভাড়া নেন। বিকেলে সৈকতে গেলে সাড়ে ৫টার দিকে তার স্বামীর সঙ্গে এক যুবকের বাগ্‌বিতণ্ডা হয়।

এর জের ধরে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার কিছু পর পর্যটন গলফ মাঠের সামনে থেকে তার আট মাসের সন্তান ও স্বামীকে কয়েকজন তুলে নিয়ে যায়। আর তাকে একটি সিএনজি অটোরিকশায় জোর করে তুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। তারপর ওই নারীকে শহরের একটি ঝুপড়ি চায়ের দোকানে নিয়ে প্রথমে তিনজন ধর্ষণ করে। তারপর নেয়া হয় হোটেল-মোটেল জোনের জিয়া গেস্ট ইন নামের একটি হোটেলে।

সেখানে মাদক সেবনের পর সন্তান ও স্বামীকে হত্যার ভয় দেখিয়ে আবার ধর্ষণ করে এক যুবক। এরপর হোটেল কক্ষ বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়ে সে চলে যায়। ওই নারীর দাবি অনুযায়ী, জিয়া গেস্ট ইনের তৃতীয় তলার জানালা দিয়ে রাস্তায় হেঁটে যাওয়া এক যুবকের সহায়তা চান। পরে ওই যুবক এসে কক্ষের দরজা খুলে তাকে বের করেন। এর কিছুক্ষণ পর ওই নারী ফোন দেন ৯৯৯-এ।

তিনি বলছেন, ‘৯৯৯-এ ফোন করার পর আমাকে ফোন দেন কক্সবাজার সদর মডেল থানার এক কর্মকর্তা। তাকে নাম-পরিচয় না বললেও পুরো বিষয়টি জানাই। কিন্তু তিনি আমার কাছে না এসে উল্টে থানায় গিয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার পরামর্শ দেন। ‘একপর্যায়ে আমি হোটেলে-মোটেল জোনে বসানো সাইনবোর্ড থেকে র‍্যাবের নম্বর পাই। যোগাযোগ করা হলে তারা দ্রুত এগিয়ে আসেন।’

অভিযোগকারী নারীর বক্তব্যের সূত্র ধরে বৃহস্পতিবার দিনভর কক্সবাজারের বিভিন্ন জায়গায় অনুসন্ধান করেছে। ঘটনার ধারাবাহিকতা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট এলাকার বিভিন্ন ব্যক্তির বক্তব্য নেয়া হয়েছে। ওই নারীর বক্তব্য অনুযায়ী, সৈকতের লাবনী পয়েন্টের যে জায়গায় তার স্বামীর সঙ্গে প্রথমে এক যুবকের বাগ্‌বিতণ্ডা হয়, সেখানে বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রচুর পর্যটকের সমাগম দেখা গেছে।

অভিযোগ অনুযায়ী, বাগ্‌বিতণ্ডার পর অভিযুক্ত যুবক ওই দম্পতির পিছু নিয়ে লাবনী পয়েন্টের ঝিনুক মার্কেট পর্যন্ত যায়। সেখানে তার সঙ্গে যোগ দেয় আরও দুজন। এই বিতণ্ডা চলতে থাকে গলফ মাঠের কাছাকাছি পর্যন্ত। সেখানে যুবকদের সঙ্গে যোগ দেয় আরও কয়েকজন।

এরপর সন্ধ্যা ৭টার দিকে একটি সিএনজি অটোরিকশায় স্বামী ও সন্তানকে তুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। আরেকটি অটোরিকশায় তিন যুবক ওই নারীকে জোর করে তুলে নেয়।

এই অভিযোগ র‌্যাবকে জানিয়েছেন ওই নারী। তবে লাবনী পয়েন্টে বুধবারের এই ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী বক্তব্য জানতে পারেনি নিউজবাংলা।

ওই নারীর অভিযোগ, শহরের বিভিন্ন অলিগলি ঘুরিয়ে তাকে একটি ঝুপড়ি চায়ের দোকানে নিয়ে যায় তিন যুবক। নিউজবাংলার অনুসন্ধানে সেই চায়ের দোকানটি চিহ্নিত করা গেছে।

গলফ মাঠের পশ্চিম দিকে ঝাউবনের পাশেই চা দোকানটি পাওয়া গেছে। এর উল্টো দিকে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইএমও) সাব-অফিসের অবস্থান।

ঝুপড়ি দোকানটি চালান ছেনুয়ারা বেগম নামের এক নারী। দোকানের পেছনের দিকে কয়েকটি কক্ষ দূরপাল্লার বাসের চালক-সহকারীদের রাতযাপনের জন্য ভাড়া দেয়া হয়। ভাঙাচোরা রাস্তার কারণে এলাকাটি সন্ধ্যার পর থেকেই অনেকটা নির্জন।

ছেনুয়ারা বেগম স্বীকার করেছেন বুধবার রাত ৮টার দিকে এক নারীকে নিয়ে আসেন স্থানীয় আশিক ও জয়। তাদের সঙ্গে আরও এক যুবক থাকলেও তিনি তার পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেননি।

ছেনুয়ারা বেগম জানান, আশিক ও জয়ের বাড়ি দোকানের আধ কিলোমিটারের মধ্যে। প্রায়ই তারা আসত বলে দুজনেই ছেনুয়ারার পরিচিত।

ছেনুয়ারা বলেন, ‘বুধবার রাত সোয়া ৮টার দিকে আশিক, জয়সহ তিনজন সিএনজি অটোরিকশায় এসেছিল। তাদের সঙ্গে একটি মেয়েও ছিল। তারপর আমার দোকানের পেছনের দিকে গাড়ির হেলপারদের ঘুমানোর রুমে মেয়েটিকে নিতে দেখেছি।’

ছেনুয়ারা বলেন, ‘প্রায় আধ ঘণ্টা পর রুম থেকে এসে আশিকরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে আমার দোকান থেকে একটু দূরে যায়। তখন ওই মেয়েটি আমার কাছে এসে তার স্বামী ও সন্তানকে ফিরিয়ে দিতে আশিককে সুপারিশ করতে বলে। এর কয়েক মিনিট পরেই তারা মেয়েটিকে নিয়ে ওই একই অটোরিকশায় চড়ে কবিতা চত্বরের দিকে চলে যায়।’

ছেনুয়ারা ঘটনাটি কেন আর কাউকে জানাননি, সে ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যা তার কাছে পাওয়া যায়নি।

ওই নারীর অভিযোগ অনুযায়ী, ঝুপড়ি চা দোকানটি থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় জিয়া গেস্ট ইন হোটেলে। জিয়া গেস্ট ইনের রেজিস্ট্রার খাতার তথ্য অনুযায়ী, ওই নারীকে নিয়ে আশিক বুধবার রাত ৯টা ৮ মিনিটে হোটেলে আসেন। খাতায় দুজনের নামই এন্ট্রি করার পর তাদের তৃতীয় তলার ২০১ নম্বর কক্ষ দেয়া হয়।

ওই সময়ে হোটেল ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন রিয়াজউদ্দিন ছোটন। তাকে বুধবার গভীর রাতে আটক করে র‌্যাব। র‌্যাবের দাবি, আশিকের সঙ্গে ছোটনের আগে থেকেই সখ্য ছিল। ওই নারীকে হোটেলে নিয়ে যাওয়া এবং বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে লবির সিসিটিভি ফুটেজ পেয়েছে। এতে দেখা যায়, হোটেলে যাওয়ার প্রায় ৪০ মিনিট পর রাত ৯ টা ৪৫ মিনিটের দিকে বেরিয়ে যাচ্ছে আশিক। তার কিছু সময় পর নেমে আসেন ওই নারী। ওই নারীর অভিযোগ, রুমের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেয়ায় তিনি আটকে পড়েছিলেন। এরপর কক্ষের জানালা দিয়ে টেলিভিশনের রিমোটের একটি ব্যাটারি ছুড়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক যুবকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরে ওই যুবক এসে দরজা খুলে তাকে বের করেন। তবে জিয়া গেস্ট ইন-এর আরেক ম্যানেজার আমির হোসেনের দাবি, তাদের হোটেলের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করা সম্ভব নয়। এটি শুধু ভেতর থেকে বন্ধ করার ব্যবস্থা রয়েছে। তিনি দাবি করেন, কক্ষ ভাড়া নেয়ার সময়ে আশিকসহ দুজনকেই ‘স্বাভাবিক’ মনে হয়েছে হোটেল কর্মীদের।

নিয়ম অনুযায়ী কক্ষ ভাড়া দেয়ার সময় দুজনের পরিচয়সূচক নথি কেন জমা রাখেনি হোটেল কর্তৃপক্ষ, তেমন প্রশ্নের জবাব দেননি আমির। তবে তিনি বলেন, ‘আশিকের সঙ্গে ম্যানেজার ছোটনের আগে থেকেই পরিচয় ছিল। এর আগেও আশিক হোটেলে রাত্রিযাপন করেছে।’

ওই নারী র‌্যাবকে জানিয়েছেন, আশিক হোটেলে ঢোকার পর তার ভ্যানিটি ব্যাগ ও মোবাইল ফোন ম্যানেজার ছোটনের কাছে জমা রেখেছিল। তিনি কক্ষ থেকে বের হওয়ার পর সেই মোবাইল ফোন নিয়ে প্রথমে স্বামীকে ফোন করেন। দুর্বৃত্তরা ইতোমধ্যে তার স্বামী ও সন্তানকে ছেড়ে দিয়েছিল।

ফোন করার পর সন্তানকে নিয়ে তার স্বামী ঘটনাস্থলে আসেন। এরপর তারা আলোচনা করে ৯৯৯-এ ফোন করেন।

তবে পুলিশ ঘটনাস্থলে না এসে থানায় গিয়ে জিডি করতে বললে তারা র‌্যাবকে ঘটনাটি জানান। এরপর রাত ১১টা ৫০ মিনিটের দিকে র‌্যাব ওই হোটেলে আসে।

র‌্যাবের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওই নারীর স্বামীকে আটকে রাখা যুবক বাবুকেও শনাক্ত করা হয়েছে। তবে চায়ের দোকানে আশিক ও জয়ের সঙ্গে থাকা তৃতীয় যুবক এখনও চিহ্নিত হয়নি। আশিক, জয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকার কথা স্বীকার করেছে হোটেল ম্যানেজার ছোটন। যার ফলে হোটেলে এসে নানা অপরাধ করত তারা।’

এ ঘটনায় ওই নারীর স্বামী বৃহস্পতিবার রাতে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় একটি মামলা করেছেন। এতে আশিক, জয়, বাবু, ছোটনের নাম উল্লেখসহ মোট সাতজনকে আসামি করা হয়েছে।

থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মুনীরুল গিয়াস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওই নারীকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।’


Comments are closed.

ইমেইল: arahmansat@gmail.com
Design & Developed BY CodesHost Limited
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com