November 21, 2024, 8:41 am

সাংবাদিক আবশ্যক
সাতক্ষীরা প্রবাহে সংবাদ পাঠানোর ইমেইল: 1linenewsagency@gmail.com
খোলাবাজারে চাল-আটা বিক্রি অর্ধেক করে দিয়েছে সরকার

খোলাবাজারে চাল-আটা বিক্রি অর্ধেক করে দিয়েছে সরকার

গত বছরের তুলনায় চলতি বছর সরকারের চাল ও গমের মজুদ অনেক বেশি। তারপরও সরকার খোলাবাজারে বিক্রির চাল ও আটার বরাদ্দ কমিয়ে অর্ধেক করেছে। এতে করে খোলা বাজারে বা ওএমএস সেন্টারগুলোর সামনে নিম্নআয়ের মানুষের দীর্ঘ লাইন। ট্রাকের বা নির্ধারিত দোকানের চাল বা আটা দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে লাইনে দাঁড়ানো মানুষেরা লাইন ভেঙে হুড়োহুড়ি করে এসব খাদ্যশস্য সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। অনেকে চাল-আটা না পেয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর রাজাবাজারের ট্রাকে করে এবং শান্তিনগর বাজারের দোকানে ওএমএসের চাল বিক্রির কেন্দ্র পরিদর্শন করে এসব চিত্র পাওয়া গেছে।

খাদ্য সচিব নাজমানারা খানুম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেশি চাল ও আটা বরাদ্দ দিলে কালোবাজারে বিক্রি হয়ে যায়। এ কারণে সীমিত পরিমাণ চাল ওএমএসে দেওয়া হচ্ছে। যেসব ট্রাকে বা দোকানে ওএমসের চাল বিক্রি করা হয়, তার সামনে দাঁড়ালেই বিষয়টি টের পাওয়া যায়। তারপরও প্রয়োজন হলে আমরা বরাদ্দ বাড়িয়ে দেব।’

গতকাল দুপুর ১২টায় রাজাবাজারে ওএমএসের চাল বিক্রির ট্রাকের সামনে গিয়ে দেখা যায় দুটো লাইন করে নারী ও পুরুষরা চাল ও আটা নিচ্ছেন। নারীদের লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ৩৯ জন আর পুরুষ লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ৩০ জন। তীব্র রোদের মধ্যে তারা দাঁড়িয়ে ছিলেন।

দুপুর দেড়টায় শান্তিনগরের ওএমএসের চাল বিক্রির দোকানে গিয়ে দেখা যায় আটা বিক্রি শেষ হয়ে গেছে। চালও শেষ পর্যায়ে। অথচ দোকানের সামনে তখনো মানুষের জটলা। তারা দীর্ঘ সময় লাইনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু যখন বুঝতে পেরেছেন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলে তারা চালও পাবেন নাতখন তারা লাইন ভেঙে দোকানের মধ্যে ঢুকে গেছেন। ওএমএস দোকানটির মালিক আবদুল আউয়াল মিন্টু দেশ রূপান্তরকে বলেন, এক টন চাল আর এক টন আটা পেয়েছি। আটাতো অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। চালও শেষ হওয়ার পথে। বরাদ্দ একটু বাড়ালে ভালো হয়। কারণ অনেক মানুষ খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন।

ওই দোকানের সামনেই চল্লিশোর্ধ দুই নারী লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে ঝগড়া করছিলেন। ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তাদের ঝগড়ায় বিরক্ত আশপাশের দোকনদাররাও। তারা জানান, এক দিন পর পর দোকানটিতে ওএমএসের চাল ও আটা বিক্রি করা হয়। অথচ প্রতিদিন নিম্ন আয়ের মানুষ এসে চাল ও আটা খোঁজ করেন।

ওএমএসের দোকানের সামনে চাল কেনার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন কাকরাইলের একটি দোকানের কর্মচারী মোমিন মিয়া। খালি ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চাল কিনতে আইছিলাম। কিন্তু পামু কি না বুঝতে পারছি না।’

ওএমএসের চাল কি ভালো? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ক্যামনে কমু। জীবনে এই প্রথম ওএমএসের লাইনে দাঁড়াইছি। আগে কি কখনো খাইছি যে কমু, ওএমএসের চাল কেমুন।’ মোমিন এ কথা বলে উদাস দৃষ্টিতে গলির শেষ প্রান্তে তাকিয়ে থাকেন।

মোমিন একটি এসি মেরামতকারী দোকানে কাজ করেন। কারিগরি কাজ জানার কারণে তার অনেক কদর ছিল। তাকে নিতে বিভিন্ন এসি মেরামতকারীদের মধ্যে টানাটানি ছিল। কিন্তু কভিড সব বদলে দিয়েছে। কভিডের প্রথম বছরতো মানুষ এসিই চালাতেন না। দ্বিতীয় বছর চালানো শুরু করলেও সরকারের কঠোর বিধিনিষেধের কারণে মালিকরা দোকানই খুলতে পারছেন না।

মোমিনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, বন্ধের সময় বেতন পান?

এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মোমিন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন। একসময় চোখের পানি লুকিয়ে মোমিন বলেন, ‘মালিকই তো চলতে পারে না। আমরে বেতন দিব ক্যামনে?’

কীভাবে চলছেন? জানতে চাইলে মোমিন বলেন, ‘ধারদেনা করে, বউয়ের গলায় একটা চেইন ছিল … সেটা বিক্রি করে। আর পারতেছি না … ওদের বাড়িই পাঠায়ে দিতে হবে।’

মোমিনের বাড়ি টাঙ্গাইল। তিনি এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হননি। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে করোনা তাকে পঙ্গু করে দিয়েছে। মোমিনকে ছেড়ে আসার সময় তখনো সে তার কাক্সিক্ষত চাল পায়নি।

বেলা সাড়ে ৩টার দিকে আবার রাজাবাজারের ট্রাকে করে চাল বিক্রির কেন্দ্রের সামনে এসে দেখা যায়, সেখানে মানুষের ভিড় আরও বেড়েছে। ট্রাক থেকে বারবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্ক পরে একটু দূরত্বে দাঁড়ানোর অনুরোধ করলেও কেউ তা আমলে নিচ্ছিলেন না। হঠাৎ আষাঢ়ের আকাশ কালো মেঘে ঢেকে যায়। লাইনের প্রায় শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে লিপি বেগম একবার আকাশের দিকে আর একবার সামনের লাইনের দিকে তাকাচ্ছিলেন। বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে তিনি আটা-চাল পাবেন তো? লাইন খানিকটা এগোনের পরই ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টিতে অনেকে লাইন ছেড়ে গেলেও লিপি লাইন ছাড়তে পারেননি। তাকে যে ওএমএসের চাল নিয়ে রান্না করতে হবে। ওড়না মাথায় দিয়ে লিপি বৃষ্টির মধ্যেই ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। বর্ষার বৃষ্টি থেমে গেলে যারা লাইন ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তারা ফিরে আসায় শুরু হয় হুড়োহুড়ি। কিন্তু ট্রাক ড্রাইভার আবদুর রাজ্জাকের কড়া হুঁশিয়ারি, ‘যারা লাইন ছেড়ে বের হয়ে গিয়েছিলেন তারা লাইনের পেছনে গিয়ে দাঁড়ান। পেছনে না দাঁড়ালে চাল আটা কিছুই দেওয়া হবে না।’

ট্রাক ড্রাইভারের কড়াকড়িতে কপাল খুলে গেল লিপি বেগমের। তিনি আধা ঘণ্টার মধ্যেই তার চাল আটা পেয়ে গেলেন। পান্থপথের বৌবাজারের বাসায় ফেরার পথে লিপি জানান কভিড কীভাবে তার সব কেড়ে নিয়েছে। তার স্বামী গর্মেন্টসে চাকরি করতেন, মাসে ১২ হাজার টাকা বেতনে। হুট করে চাকরি চলে যায়। দুই মাস বেকার থাকার পর অন্য কারখানায় ৮ হাজার টাকায় চাকরি নেন। লিপি দুটো বাসায় কাজ করতেন। দুটো বাসা থেকেই তাকে বিদায় করে দেওয়া হয়। তিনি যে বাসায় কাজ করতেন তারা কভিডের কারণে বাসা বদলে ছোট বাসা নিয়েছেন একই পাড়ায়। কিন্তু খরচ বাঁচানোর জন্য আর কাজের লোক রাখেননি। লিপি অনেক চেষ্টা করেও আর নতুন কাজ জোটাতে পারেননি। তারা বরিশালের নলছিটি থেকে এসে ঢাকার বৌবাজারে সংসার পেতেছেন। কিন্তু কভিডের সঙ্গে আর কত দিন লড়াই করতে পারবেন তা বুঝতে পারছেন না লিপি বেগম।

প্রতিটি ওএমএস সেন্টার খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের তদারকিতে থাকে। তদারককারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চাল ও আটার চাহিদা অনেক বেশি। তারা তাদের চাহিদার কথা সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছেন।

গত বছর কভিড শুরুর পর সরকারের খাদ্য মজুদ তলানিতে গিয়ে থেমে ছিল। অভ্যন্তরীণ বাজার থেকেও সরকার ধান চাল সংগ্রহ করতে পারেনি। এই অবস্থার মধ্যেও নিয়মিত কর্মসূচিগুলোর পাশাপাশি ১০ টাকা কেজি দরে চাল দিয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। একসময় এসব চাল নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর সরকার তা স্থগিত করে দেয়।

চলতি বছর কভিডের দ্বিতীয় ঢেউ আসার পর সরকার গত ১ জুলাই থেকে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে। ইতিমধ্যে এই বিধিনিষেধের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষদের ভিড় বাড়ছে খাদ্য অধিদপ্তরের ওএমএসের ট্রাক ও দোকানের সামনে। একই অবস্থা টিসিবির দোকানের সামনেও। সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন এই অবস্থায় খাদ্য অধিদপ্তরের উচিত ছিল ওএমএসের দোকান, ট্রাক বা চালের পরিমাণ বাড়ানোর। কারণ বর্তমানে সরকারের গুদামে চাল মজুদ আছে ১২ লাখ ১৫ হাজার টন আর গম মজুদ আছে ২ লাখ ৯৪ হাজার টন, যা গত বছরের চেয়ে অনেক বেশি। তারা আরও জানিয়েছেন, চুরি বন্ধ করা সরকারের দায়িত্ব। চুরি বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন বিভাগীয় ব্যবস্থা আছে। সেটা না করে খাদ্য অধিদপ্তর যদি চাল ও আটা বরাদ্দ কমিয়ে দেয় তাহলে নিম্ন আয়ের মানুষেরা কোথায় যাবে। চুরি ঠেকাতে গিয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষকে দুর্ভোগের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে সরকার। গত দুই মাস ধরেই চাল ও আটার চাহিদা বেড়েছে। কভিডের এই দিনগুলোতে মানুষের আয়ের ক্ষমতা অনেক কমেছে। সরকারের উচিত নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষদের পাশে দাঁড়ানো। চুরি ঠেকাতে গিয়ে সরকার বিরাট জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করছে। অথচ ২০১০ সাল থেকেই আওয়ামী লীগ সরকার এ কর্মসূচি চালাচ্ছে। প্রতিদিন ১৪৩টা পয়েন্টে দুই টন করে আটা আর চাল বিক্রি করা হতো। প্রতি ট্রাকে থাকে চার হাজার কেজি আটা ও চাল। এভাবে নিম্ন আয়ের মানুষদের ৫ লাখ ৭২ হাজার কেজি চাল ও আটা দেওয়া হতো। জনপ্রতি ৫ কেজি করে চাল এবং আটা দেওয়া হলে ১ লাখ ১৪ হাজার ৪০০ পরিবার উপকৃত হয়। কিন্তু গত মার্চ থেকেই আটা ও চাল বরাদ্দ অর্ধেক করে দিয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। এতে উপকারভোগী মানুষের সংখ্যা অর্ধেকে নেমেছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত ২৩ জুন ঢাকা মহানগর ও চারটি শ্রম ঘন জেলার (ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদী) মোট ২৭৬টি কেন্দ্রে দৈনিক ২ টন আটা ও ১ টন করে চাল বিক্রির জন্য খাদ্য অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্ত গত ১৫ দিনেও বাস্তবায়ন করেনি খাদ্য অধিদপ্তর।

ওএমএসে প্রতি কেজি চাল বিক্রি হয় ৩০ টাকা এবং আটা বিক্রি হচ্ছে ১৭ টাকা কেজি দরে। বাজরে প্রতি কেজি মোটা চাল ৪৮ থেকে ৫০ টাকায় এবং আটা ৩২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক বদরুল হাসান গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারের গুদামে এখন পর্যাপ্ত চাল মজুদ আছে। অতিমারির এই সময়েই খাদ্য অধিদপ্তরের উচিত আরও বেশি করে চাল ও আটা বরাদ্দ দেওয়া উচিত। সরকারের প্রতিটি স্তরেই মানবিক আচরণ করা উচিত। আর কালোবাজারের সমস্যা থাকলে কঠোর বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।’


Comments are closed.

ইমেইল: arahmansat@gmail.com
Design & Developed BY CodesHost Limited
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com