April 27, 2024, 12:24 pm

সাংবাদিক আবশ্যক
সাতক্ষীরা প্রবাহে সংবাদ পাঠানোর ইমেইল: arahmansat@gmail.com
শিরোনাম:
কালীগঞ্জে কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো চারশ’ কেজি আম জব্দ জুম্মার নামাজে মুসল্লিদের দোয়া চাইলেন মশিউর রহমান বাবু সাতক্ষীরায় অপহৃত ৮ম শ্রেণীর ছাত্রীকে উদ্ধার করলো পুলিশ সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজে পৃথক বার্ন ইউনিট না থাকায় জরুরী সেবা ঝুঁকিতে এসিড দগ্ধ ও পোড়া রুগীরা দাবদাহ উপেক্ষা করে ধান কেটে ঘরে তুলতে ব্যস্ত কৃষকরা সাতক্ষীরায় সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা-ছেলে নিহত জনপ্রিয়তার শীর্ষে নতুন মুখ প্রভাষক সুশান্ত কুমার মন্ডল আশাশুনীতে বাপ্পী সীড হাউজ দোকান উদ্বোধন দক্ষিণ খুলনার অস্ত্র ও মাদকের গডফাদার ওজিয়ার গ্রেফতার সাতক্ষীরায় টিটিসিতে ৭৫ দিন মেয়াদী দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ক প্রশিক্ষণের মতবিনিময়
জলে ভাসা জীবন ওদের, নেই কোন অধিকার

জলে ভাসা জীবন ওদের, নেই কোন অধিকার

‘মান্তা’ একটি জনগোষ্ঠীর নাম। এই জনগোষ্ঠীটি উপকূলীয় এলাকায় নৌকায় বসবাস করে। নদীর জলে ভাসা নৌকায় তাদের জন্ম, বিয়ে, জীবন-জীবিকা এবং মৃত্যু। দেশের বিভিন্ন এলাকার নদীভাঙা মানুষগুলোর পূর্বপুরুষের ঠিকানা হারিয়ে আশ্রয় জুটেছে জলে। নৌকায় তাদের আলাদা জগৎ, আলাদা একটি রাজ্য।

সভ্য সমাজ ব্যবস্থার সাথে রয়েছে রক্তের বন্ধন, রয়েছে জীবন জীবিকার সংযোগ। তবুও মান্তা জনগোষ্ঠীর জীবনে ছোঁয়া লাগেনি সভ্যতার, পায় না কোনো সরকারি সুবিদা। এ জনগোষ্ঠীর শিশুরা অধিকার বঞ্ছিত আর মানবতা বির্বজিত হয়ে বেড়ে উঠছে। তাদের ওই জীবন যেন আমাদের নাগরিক জীবনকে ব্যঙ্গ করে।

রশি বাঁধা ছেলেবেলা: পটুয়াখালী শহরের পূর্বদিকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার সড়ক পথ পেরিয়ে বাউফল উপজেলার বগি খাল। পাশেই তেঁতুলিয়া নদী। ওই খালটি বাউফল ও দশমিনা উপজেলার সীমানা নির্ধারণ করেছে। খালের মধ্যে প্রায় শতাধিক নৌকা। ওই নৌকাগুলোতে শতাধিক পরিবারের বাস। তেঁতুলিয়া নদীতে মাছ শিকার করে মান্তা পরিবারের লোকজন জীবিকা চালায়।

ভূখানাঙ্গা এ মানুষগুলো নদী ভাঙনের শিকার। ভিটামাটি আর পূর্ব পুরুষের ঠিকানা হারিয়ে এরা এখন যাযবর। নদীর জলের ওপর বসতি তাদের। মাছ শিকারের ওপর নির্ভরশীল এ মানুষগুলো যেখানে মাছের সন্ধান পায় সেই জলাশয়ের আশেপাশে নৌকা নোঙর করে। কোথাও মাথা গুজার ঠাঁই না পেয়ে সরকারি সবধরণের নাগরিক সুবিদা বঞ্চিত নৌকার এ বাসিন্দারা। জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে এসবই হয় তাদের নৌকায়। তবে দাফন হয় মাটিতে। মান্তা পরিবারে শিশুরা ভূমিষ্ট হওয়ার পর তাদের বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে অভিভাবকরা কোমরে পরিয়ে দেয় রশি। ওই রশি কোমরে নিয়েই বড় হয় শিশুরা। গোসলকরা, খাওয়া, ঘুম ছাড়া সারাক্ষণই শিশুরা নৌকায় রশি দিয়ে বাঁধা থাকে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, নৌকায় নৌকায় শিশুরা রশি দিয়ে বাঁধা। শিশুদের নানা ধরণের আকুতি। কেউ কাঁদছে, কেউ ঝুলে আছে, কেউবা আবার পানির মধ্যে হাত চুবিয়ে খেলা করার চেষ্টা। আবার কাউকে খালের পাড়ে গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। এছাড়া মা তাঁর সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ালেও শিশুটির কোমরে ঝুলছে মোটা রশি। মায়ের কোলে থাকলেও কোমরে বাঁধা থাকে মোটা রশি। এভাবেই রশির সাথে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে আছে মান্তা শিশুদের জীবন।

অপরদিকে, শিশুর কোমরে রশি বাঁধতে ভুলে গেলে বিপদ। সন্তানের কোমরে রশি বাঁধতে ভুলে যাওয়ায় গত একবছরে পটুয়াখালীর ৪ মান্তা পল্লীতে ৬ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে বগি খালে মৃত্যু হয়েছে দুজনের, গলাচিপার পানপট্টির খালে মৃত্যু হয়েছে দুজনের, রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজ বাজারের স্লুইস খালে মৃত্যু হয়েছে একজনের এবং গলাচিপার রামনাবাদ খালে মৃত্যু হয়েছে এক মান্তা শিশুর। প্রতিবছরই পানিতে ডুবে মান্তা শিশুর মৃত্যু হয় বলে জানালেন শিশুদের অভিভাবকরা। তবে যেভাবে রশি দিয়ে শিশু নৌকায় বাঁধা থাকে তাতেও মৃত্যু ঝুঁকিতে থাকে শতভাগ। আর রশি বাঁধা না থাকলে মৃত্যু ঝুঁকি আরো বেড়ে যায় এমন বক্তব্য অভিভাবকদের।

মান্তা পরিবারের অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শিশু জন্মের দুই থেকে তিনদিন পরই সন্তানদের কোমরে মোটা রশি পরিয়ে দেয়া হয়। কারণ নৌকায়ই সার্বক্ষণিক তাদের বসবাস। তাই নদীতে অনেক সময় ঢেউ থাকে তাতে নৌকা দোলে তখন সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া শিশুটি পানিতে পড়ে যেতে পারে। এ কারণে কোমরে জন্মের দুই এক দিনের মধ্যেই রশি লাগানো হয়। ওই রশির অভিশাপ থেকে পাঁচ কিংবা ছয় বছরের আগে (সাঁতার শেখা পর্যন্ত) মুক্তি মেলে না মান্তা শিশুদের। এ রশি শিশুকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অভিভাবকদের হাতিয়ার হলেও কখনো কখনো রশি নির্মম হয়ে ওঠে শিশুর প্রাণনাশে।

আমানত সরদার জানান, তিন বছর আগে তাঁর দুই বছরের শিশু সন্তান রুবেলকে রশি দিয়ে নৌকায় বেঁধে রাখেছিলো স্ত্রী রাহিমা বেগম। তখন তিনি নৌকায় ছিলেন না। কাজে ব্যস্ত থাকা রাহিমা বেগমের অজান্তে রুবেল রশি বাঁধা অবস্থায় নৌকা থেকে নদীতে পড়ে মারা যায়। পরে রশি থাকার কারণে খুব সহজে রুবেলের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিলো। সহজে মৃতদেহ পাওয়াটা তাদের এক ধরণের সান্তনা। এ রকম ঘটনা মাঝেমধ্যে মান্তা পরিবারে ঘটে বলে দাবি তাদের।

মান্তা পরিবারগুলো শিশুদের রশির বন্দিদশা থেকে মুক্তি চায়। নৌকা থেকে ভূমিতে বসবাসের স্বপ্ন তাঁদের। কিন্তু কিনারা খুঁজে পায় না। মান্তা পরিবারের সদস্যরা জানান, তাঁদের বেঁচে থাকার মত নৌকা, বড়শি আর জাল ছাড়া কিছুই নাই। ভাসতে ভাসতে যেখানেই তারা নোঙর করে ওই এলাকার প্রশাসন কিংবা জনপ্রতিনিধিরা এদের নাগরিক হিসাবে গ্রহণ করে না। বিভিন্ন এলাকা থেকে নৌকায় ভাসা ওই মানুষগুলোর আস্তানা হয় নদী কেন্দ্রিক। ফলে যে এলাকায় অবস্থা নেন ওই এলাকার জনপ্রতিনিধিরা মনে করেন তারা তাদের ভোটার না এ কারণে কোনো ধরণের সরকারি সুবিধা এরা পায় না। এ জন্য প্রশাসনের লোকজনও তাঁদের খোঁজখবর রাখে না। সারাক্ষণ জাল নৌকা নিয়ে পেটের ধান্দা মেটানোর তাগিদে জন্মনিবন্ধন, জন্ম সনদ কিংবা মৃত্যু সনদ, জাতীয় পরিচয় পত্রের সাথেও এরা অপরিচিত।

নুরু সরদারের স্ত্রী সেতারা বেগম বলেন, আমার ৯ডা গুরাগ্যারা অইছেলে। একটা দড়ি (রশি) ছুইট্টা পানিতে ডুইব্বা মরছে। একটা মরছে অসুখ অইয়া। সাতউগা (সাত) বাইচ্চা আছে। য্যারা বাইচ্চা রইছে সবাইরে দড়ি দিয়া বাইনগা (বেঁধে) বড় করছি।

আবুল হোসেন সরদার নামের এক অভিভাবক বলেন, আমার দুইডা পোলা নদীতে পইড়া মরছে। পানিতে আর থাকতে মোল্লায় (ইচ্ছা) না। সরকার যদি আমাগোরে নদীর ধারে একটা জমি বা ঘর উডাইয়া দেয় চাষবাসের লইগ্যা খাস জমি দেয়। আমাগো পোলাপান বাইনগা (বেঁধে) বড় করণ লাগবে না। ছাড়াইগা (ছেড়ে বা মুক্ত) পালতে পারমু। নদীতে থাহি দেইক্যা আমাগোরে কেউ কিছু দেয় না।

বগি এলাকার স্থানীয় এক বাসিন্দা হেদায়েত মুন্সি আক্ষেপ করে বলেন, গরু ছাগলের বাচ্চাও বাঁধন খুলে লালন পালন করা হয়। আর এরা মানুষের বাচ্চা হয়েও সব সময় বাঁধা থাকে। এদের জন্য সরকারের কিছু একটা ভালো কাজ করা উচিত। শিশুদের বেঁধে রেখে বড় করার এ ঘটনা আমাদের জীবনকে উপহাস করা ছাড়া আর কিছুই না।

পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ সহকারি অধ্যাপক মো. অহিদুজ্জামান শামীম বলেন, জন্মের পর শিশুরা ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। হামাগুড়ি দিয়ে চলাচলে ক্রমশ তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ শুরু হয় এবং শিশুরা বুঝে এবং শিখে। কিন্তু ওই বয়সে শিশুরা বন্দিদশার মধ্যে থাকলে অবশ্যই মানসিক বিকাশ বাঁধার মুখে পড়ে। ওইসব শিশুরা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা শিশুর চেয়ে অবশ্যই আলাদা স্বভাবের হবে। পানি বা ভাসমান জীবন থেকে ওই জনগোষ্ঠীকে বের করতে পারলে ওই শিশুরাই স্বাভাবিক এবং সুস্থ ভাবে বেড়ে উঠবে।

পুতুল খেলার বয়সে বিয়ে: মাত্র ১৩ বছর বয়স পেরিয়ে ১৪তে পড়েছে নুপুরের বয়স। এরই মধ্যে নুপুর চার মাসের অন্তস্বত্ত্বা। নুপুরের সঙ্গে দেখা হয় বগি খালে। নুপুর তাঁর বড় বোন আছিয়ার সাথে নৌকা নিয়ে তেঁতুলিয়া নদীতে মাছ শিকারে যাচ্ছে। নুপুর বলেন, বাপ-মায় গত বছর বিয়া দেছে আমি কি করমু। তাঁর স্বামীর নাম শিপন। ওই জনগোষ্ঠীর সন্তান, বয়স ১৬ বছর। নুপুর আরও বলেন, আমরা গরিপ (গরিব)। আমাগো মাছ ধইরগাই সংসার চলে। আমাগো নৌকার সবাইর বিয়া ১২, ১৩ বচ্ছর বয়সে অয় (হয়)।

নুপুরের সঙ্গে কথা শেষ না হতেই দেখা মেলে আরেক শিশুবধূ মরিয়মের সাথে। মরিয়মের বয়স ১৪ কিন্তু সে ১ সন্তানের জননী। সেও ওই নদীতে মাছ শিকার করে। এ সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক শিশুবধূ রাবেয়া। তাঁর কোল জুড়েও রয়েছে ১ বছরের শিশু সুজন। রাবেয়ার বয়স চৌদ্দ বছর। তাঁর চোখে-মুখে এখনও শিশু বয়সের ছাপ। তবুও জীবন খেলায় ব্যস্ত শিশু রাবেয়া। নিজের শিশু বয়স অথচ সন্তান জন্ম দিয়ে বইছে আরেক শিশুর বোঝা। কত বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে তা স্পষ্ট করে বলতে পারেনি রাবেয়া। তবে কপাল কুচকে আর মাথা হেলিয়ে রাবেয়া বলেন, ‘বিয়া অইছে তিন বচ্ছর তো-অইবেই। আমার যহন বিয়া অইছে তহন আমি হাফ প্যাট পরি।

পটুয়াখালীর বাউফল ও দশমিনা উপজেলার সীমানা নির্ধারণ করা বগি খালে রাবেয়ার নৌকা। স্বামী রুবেল সরদার। ওই বহরের অন্য নৌকার লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রাবেয়ার যখন বিয়ে হয়েছিল তখন তার (রাবেয়া) বয়স ১০ বছরের বেশী হয়নি। বিয়ের দুইদিন পরই স্বামীর সংসার সাজাতে দায়িত্ব শুরু। ইতিমধ্যে ১ সন্তানের মা সে। শিশু বয়সেই ভেঙে পড়েছে রাবেয়ার শরীর।

এ বিষয়ে রাবেয়া বেগম বলেন, বিয়ার বয়স অইছে দেইক্যাই বাপ-মায় বিয়া দেছে। নৌকার সবাই ওই অয়সেই বিয়া অয়। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় চর কাজল খালে মান্তা পরিবারের কুলসুম বিবির সাথে বিয়ে হয় রিপন সরদারের। খুবই দুর্বল শারীরিক কাঠামো নিয়ে স্বামীর সংসার শুরু করেছে কুলসুম। কুলসুম বলেন, বাপ-মায় বিয়া দেছে, আমি কি করমু। বিয়ার বয়স না অইলে কি বিয়া দেতে?

বাল্যবিয়ে দিয়ে জীবন শুরু হওয়ার এ অবস্থা শুধু রাবেয়া, মরিয়ম, নুপুর আর কুলসুমের জীবনই আসেনি। মান্তা সম্প্রদায়ের প্রতিটি নৌকায় যে মেয়েদের বিয়ে হয় সবাই এ নিয়মে বাঁধা। পটুয়াখালীর বিভিন্ন নদী তীরবর্তী এলাকায় নৌকায় বসবাস করা মান্তা পরিবারের মেয়েরা শিশুবধূ হয়েই সংসার শুরু করে। এটি অভিশাপ হলেও অভিভাবকরা মনে করেন কন্যা বিদায়ের দায় মুক্তি। এ সংস্কৃতি এদের জীবনকে খামছে ধরেছে। কত বছর বয়সে কন্যা সন্তানের বিয়ে দেয়া উচিত তা জানে না মান্তা পরিবারের অভিভাবকরা। এমনকি বিয়েতে কাজী দ্বারা রেজিষ্ট্রির করার বিষয়টিও তারা আমলে নেন না। ফলে প্রয়োজন হয় না বর বা কনের জন্ম সনদের। মূলত এসব বিষয়ে তাঁদের কোন ধারণাই নাই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার বাউফল উপজেলার নারাইনপুর খাল, কালাইয়া খাল, হোগলা খাল, তালতলি খাল, গলাচিপা উপজেলার উলানিয়া খাল, পক্ষিয়া খাল, চরকাজল খাল, বোয়ালিয়া খাল, পানপট্টি খাল, বদনাতলী খাল, রামনাবাদ খাল, পাউট্টা খাল ও ডেবপুরা খাল, রাঙ্গাবালী উপজেলার ছোটবাইশদিয়া খাল, চালিতাবুনিয়া খাল, বড় বাইশদিয়া খাল, কোড়ালিয়া খাল ও চরমোন্তাজ স্লুইস বাজার খালে প্রায় ১০ হাজারের অধিক সংখ্যক মান্তা পরিবারের নৌকায় জলে ভাসে। ওইসব পরিবারের সিংহভাগ মেয়েদের ১০ থেকে ১৩ বছর বয়স হলেই অন্য নৌকায় পাত্র খুঁজে বিয়ে দেয়া হয়।

বগি খালের কদম আলীর স্ত্রী পিয়ারা বেগম (৩০) জানান, আট কিংবা নয় বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। বর্তমানে পাঁচ সন্তানের জননী তিনি। অভিভাবকরা শিশু বয়সে কন্যা সন্তানকে বিয়ে দেয়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন। বিয়েতে কাজী ডাকা হয় না। শুধু কলেমা পড়িয়ে কবুল বলতে পারা একজন হুজুর বা মৌলভী ডেকে কন্যা শিশুকে বিয়ে দেয়া হয়।

পিয়ারা আরো বলেন, বিয়া ছাড়া আমাগো নৌকার মাইসস্যের (মানুষের) কোনো আনন্দ অয় না। আনন্দ-ফুর্তির লইগ্যা কোম বয়সে মাইয়াগো বিয়া অয়। আর বোঝেন-ই-তো স্যার বিয়ার লইগ্যা এউক্কা (একটা) পোলা, আর এউক্কা মাইয়া অইলেই অয়। আমাগো নৌকায় গুরাগ্যারার (ছেলে-মেয়ে) অভাব নাই। কোম বয়সে বিয়া অইলেও বয়স তো বাড়তেই থাহে। আমি সাবল্লক (সাবালিকা) অইছি স্বামীর নৌকায় যাইয়া। আমার বিয়ায় নৌকার মাইস্যে খুবই আনন্দ ফূর্তি করছে।

প্রায় একই ধরণের বক্তব্য দেন, কালু সরদারের স্ত্রী তিন সন্তানের জননী রাহিমা বেগম (২৮), শুক্কুর সরদারের স্ত্রী সূর্য বেগম (১৫) (সূর্য বর্তমানে গর্ভবতী)। রিপন সরদারের স্ত্রী ১ সন্তানের জননী মুক্তা বেগম (১৬)। এদের সবারই বিয়ে হয়েছে ১৩ বছর বয়সের মধ্যে। অভাব আর বিচ্ছিন্নতার কারণে মান্তা জনগোষ্ঠী জীবনে কোনো সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কিংবা ধর্মীয় উৎসবের ছোঁয়া লাগে না। এ কারণে শুধু বিয়েই তাদের একমাত্র উৎসব। তাই বিধি-বিধান না জানা এবং সচেতনতার অভাবে ছোট ছোট শিশুদের বিয়ে দিয়ে এরা আনন্দ ফূর্তি করে নৌকায়।

মান্তা সম্প্রদায়ের লোকজন পরিকল্পিত পরিবার সম্পর্কেও অজ্ঞ। কারণ এদের নৌকা বহরে পা পড়ে না কোন স্বাস্থ্য কর্মীর। সরকারের এদের জন্য নেই কোন পরিকল্পনা। তাই জন্ম নিয়ন্ত্রণ কি তা তারা জানে না এবং শিশু স্বাস্থ্য সম্পর্কেও এরা অসচেতন। ফলে ফি বছর পোয়াতি হয় মায়েরা। এসব কারণে অধিকাংশ মা ১৮ বছরের মধ্যে একাধিক সন্তানের জন্ম দেয়। তছাড়া বয়স যত বাড়ে মান্তা মায়েদের সন্তানও তত বাড়ে।

আনছার সরদারের স্ত্রী মিনারা খাতুন (৪৫) ৯ সন্তানের জননী। পরিবার পরিকল্পনা বা জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে তিনি বলেন,‘ওইসব আমরা বুঝি না। আমাগোরে কেউ ওইসব কিছু কয় নাই। নদী ভাঙনের কারণে ভিটেমাটি হারিয়ে এরা জলে নৌকা ভাসিয়ে মাছ শিকার করে জীবিকা চালালেও এরা ফিরতে চায় ডাঙায়। একখণ্ড জমির মালিক হতে চায়। কিন্তু ভাগ্য বিড়ম্বিত এ মানুষগুলোর ওই দাবি কখনও জোয়ারের মতো নিজেদের মধ্যে তীব্র হয় আবার অভাবের কারণে ভাটার মতো বেমালুম ভুলে যায়। পেটের তাগিদে সারাক্ষণ নদীতে জাল কিংবা বড়শি নিয়ে ব্যস্ত থাকে তাই ওই দাবি নিয়ে তারা দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তির দরবারে যেতে পারে না। ফলে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে বছরের পর বছর।

বাউফল ও রাঙ্গাবালী উপজেলার দায়িত্বে থাকা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. মাহাবুব হাসান ভূঁইয়া বলেন, এদের স্থায়ী বসতির অভাবে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠ কর্মীরা এদেরকে সেবা দিতে পারছে না। কারণ এদের কোনো হোল্ডিং নম্বর নাই। তবে এ জনগোষ্ঠীর লোকজন যদি আমাদের কোনো কর্মীর কাছে গিয়ে সেবা চায় তাহলে আমাদের কর্মীরা সেবা দিতে বাধ্য। কিন্তু অসচেতনতার কারণে এরা কোনো কর্মীর কাছে সাধারণত যায় না। নদী তীরবর্তী এলাকায় আবাসন বা আশ্রয়ণ প্রকল্পে স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করা হলে আমাদের কর্মীরা এদেরকে সবধরণের সেবা দিতে পারবে।

জেলা মহিলা বিষায়ক কর্মকর্তা শাহিদা বেগম বলেন, এসব জনগোষ্ঠীর জন্য মন্ত্রণালয় থেকে লিখিত পরিকল্পনা চাওয়া হলে আমরা তা প্রস্তুত করে দিব। তবে মৌখিকভাবে এই সম্প্রদায় সম্পর্কে এবং এদের জীবনমান সম্পর্কে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষে অবহিত করা হয়েছে।

জীবিকার সংজ্ঞা পাঁচে: ৭ বছরের শিশু রাজিব। গভির তেঁতুলিয়া নদীতে মাছ শিকাররত অবস্থায় মাথা নুঁয়ে বলেন, মাছ না ধরলে আমরা খামু কি। নৌকার ছোড-বড় সবাই মাছ ধরে। আমাগো তো অন্য কোনো কাম নাই। মাছ পাইলে বেইচ্চা নগদ টাহায় চাউল কেনে বাবায়। মাছ না পাইলে টাহা ধার করে। আমাগোরে সরকার কোনো চাউল দেয় না। কেউই কিছু দেয় না। আমাগো কামাই আমাগোই করতে অয়। জীবনের বাস্তবতায় ৭ বছর বয়স পার হওয়া শিশু রাজীবের এসব কথা ঠোটের আগায় খইয়ের মতো ফোটে।

রাজিবের সাথে কথা বলে আরো জানা যায়। শিশু বয়স থেকে মাছ শিকার করা মান্তা শিশুদের রেওয়াজ। এটাই তাঁদের একমাত্র জীবিকা। বেঁচে থাকা, বর্তমান অথবা ভবিষ্যৎ এসবই নদীর মাছ শিকারকে ঘিরে। তাই মাছ শিকারে বয়সের কোন সীমা রেখা নেই। নৌকায় বসবাস করা মান্তা জনগোষ্ঠীর অভিভাবকরা সন্তান জন্মের দুই থেকে তিনদিনের মধ্যে শিশু সন্তানদের সাথে নিয়েই মাছ ধরতে নদীতে যায়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মান্তা শিশুরাও ওই কর্মকে আপন করে নেয়। নদীই হয় তাদের একমাত্র ভবিষ্যৎ। একপর্যায়ে শিশুর বয়স পাঁচ থেকে ছয় বছর অতিক্রমের পর শিশুদের আলাদা নৌকা এবং জাল কিংবা বড়শি দিয়ে নদীতে পাঠানো হয়। চলবে…


Comments are closed.

ইমেইল: arahmansat@gmail.com
Design & Developed BY CodesHost Limited
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com