April 27, 2024, 1:06 pm
খুলনার পাইকাছায় নানা আয়োজনে বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল রায় (পিসি রায়) ১৬১তম জন্মবার্ষিকী পালিত হয়েছে। মঙ্গলবার বিকালে উপজেলার রাড়-লী বিজ্ঞানীর বসতভিটায় তার প্রতিকৃতিতে মাল্যদান ও আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। খুলনা জেলা প্রশাসক মনিরুজ্জামান তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, সংষ্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এমপি। বিশেষ অতিথি পাইকগাছা-কয়রা এমপি আক্তারুজ্জামান বাবু, উপজেলা চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার ইকবাল মন্টু, পৌর মেয়র সেলিম জাহাঙ্গীর, আচার্য পিসি রায় স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ শাহাদাৎ হোসেন বাচ্চু ও ইউপি চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মমতাজ বেগম। সকালে বিজ্ঞানীর প্রতিকৃতিতে স্থানীয় আ.লীগ, রাড়-লী ভুবন মোহনী বালিকা বিদ্যালয়, আর.কে.বি.কে হরিশ্চন্দ্র কলেজিয়েট ইনস্টিটিউট, শহীদ কামরুল মাধ্যমিক বিদ্যালয়, যুবলীগ, সিপিপিসহ বিভিন্ন সংগঠন পুষ্পমাল্য অর্পণে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এর আগে সকালে সাড়ে ১০টায় প্রতিমন্ত্রী কপিলমুনি বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ্যে পরিদর্শন ও পুষ্পমাল্য অর্পন করেন। এসময় উপস্থিত ছিলেন, সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু, উপজেলা চেয়ারম্যান আনোয়ার ইকবাল মন্টু, নির্বাহী অফিসার মমতাজ বেগম, ইউপি চেয়ারম্যান কওছার আলী জোয়ার্দ্দার, উপজেলা আ.লীগের যুগ্ন-সাধারণ সম্পাদক আনন্দ মোহন বিশ্বাস, লতা ইউপির চেয়ারম্যান কাজল কান্তি বিশ্বাস, ইউনিয়ন আ.লীগের সভাপতি যুগোল কিশোর দে, কপিলমুনি প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও আ.লীগ নেতা হেদায়েত আলী টুকু, ইউনিয়ন আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন খোকন, উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তানজীন মোস্তাফিজ বাচ্চু, ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান মোল্লা, কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি আজমল হোসেন বাবু, ইউপি সদস্য মুস্তাফিজুর রহমান মিন্টু, রবিন অধিকারী, শেখ রবিউল ইসলাম, রফিকুল হাওলাদার, অজিয়ার মোড়ল ও যুবলীগ নেতা প্রদীপ অধিকারী প্রমুখ। ১১টায় উপজেলা আ.লীগের দলীয় কার্যালয়ে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করেন সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, এমপি মো. আক্তারুজ্জামান বাবু সহ উপজেলা আ.লীগ ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। দুপুর ১২টায় কয়রা মসজিদকুড় পীর খানজাহান আলী (রঃ) মসজিদ, আমাদী দীঘি, কাবাড়ীপাড়া কালিমন্দির পরিদর্শন এবং বিকাল সাড়ে তিনটায় আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন।
উল্লেখ্য ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে ২ আগস্ট খুলনার পাইকগাছায় বাড়-লী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন পিসি রায়। বহু প্রতিভার অধিকারী প্রখ্যাত এ বাঙালি বিজ্ঞানী ছিলেন রসায়নবিদ, শিক্ষক, দার্শনিক ও কবি। তিনি বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রতিষ্ঠাতা এবং মার্কারি (ও) নাইট্রেটের আবিষ্কারক। পিসি রায়ের বাবা হরিশ চন্দ্র ও মা ভুবনমোহিনী দেবী। তার বাবা ছিলেন স্থানীয় প্রসিদ্ধ জমিদার। ছেলেবেলা থেকেই পিসি রায় অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তার পড়াশোনা শুরু হয় পিতার প্রতিষ্ঠিত স্কুলে। ১৮৭২ সালে তিনি কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন, কিন্তু রক্ত আমাশয়ের কারনে তার পড়ালেখা বিঘিœত হলে বাধ্য হয়ে তিনি নিজ গ্রামে ফিরে আসেন। গ্রামে থাকার সময় তার জীবনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। তিনি বাড়ির গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত নানা বিষয়ের প্রচুর বই পড়েন। ওই সময় কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন অলেকজান্ডার পেডলার। খ্যাতিমান এ অধ্যাপকের সান্নিধ্যে এসে রসায়নের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায় তার। কলেজের পাঠ্যবই ছাড়াও বিভিন্ন পাঠাগার থেকে রসায়নের বই সংগ্রহ করে পড়তেন। নিজের চেষ্টায় বাড়িতে পরীক্ষাগার স্থাপন করে রসায়ন সম্পর্কে নানা রকম পরীক্ষাও চালাতেন ঐ সময়ে। দেশের গর্ব বরেণ্য এ বিজ্ঞানী ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন কলেজে (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ) ভর্তি হন। ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে সেখান থেকে এফ এ পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে পাস করে তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। প্রেসিডেন্সী থেকে গিলক্রিস্ট বৃত্তি নিয়ে তিনি স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে বিএসসি এবং ডিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। পরে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ওই সময় তিনি শ্রেষ্ঠ গবেষণাপত্রের জন্য ‘হোপ প্রাইজ’এ ভূষিত হন। ইউরোপের নানা দেশ ঘুরে ১৮৮৮ সালে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় দেশে ফিরে আসেন। সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। ১৮৯৫ সালে তিনি মারকিউরাস নাইট্রাইট আবিষ্কার করেন যা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। এটি তার অন্যতম প্রধান আবিষ্কার। সমগ্র জীবনে মোট ১২টি যৌগিক লবণ এবং পাঁচটি থায়এস্টার আবিষ্কার করেন তিনি। ১৯০৩ সালে চারটি গ্রামের নাম মিলে বিজ্ঞানী স্যার পিসি রায় দক্ষিণ বাংলায় প্রথম আর.কে.বি.কে হরিশচন্দ্র ইনস্টিটিউট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করেন। এরআগে একইস্থানে স্যার পিসি রায়ের পিতা উপমহাদেশে নারী শিক্ষার সম্প্রসারণে ভুবনমোহিনীর নামে ১৮৫০ সালে রাড়-লী গ্রামে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে যখন বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলন সক্রিয় হয়ে ওঠে, তখন গোপণে অস্ত্র ক্রয়ের জন্য তিনি বিপ্লবীদের সাহায্য করেন। ১৯০৯ সালে নিজ জন্মভূমিতে কো-অপারেটিভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৬ সালে কলকাতায় তিনিই প্রথমবারের মত মহাত্মা গান্ধীর জনসভা আয়োজন করেছিলেন। ১৯৩৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভারতবর্ষের মহিশুর ও বেনারশ বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। এছাড়া মৃত্যুর আগে তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি ও নাইট উপাধি অর্জন করেন। ১৯৪৪ সালে ১৬ জুন জীবনাবসান ঘটে চিরকুমার বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের। এই বিজ্ঞানী তাঁর জীবনের অর্জিত সমস্ত সম্পত্তি মানব কল্যাণে দান করে যান।