April 27, 2024, 9:07 am
খুলনার পাইকগাছায় একটি অঞ্চল জুড়ে বাতাসে পোড়া কাঠের উটকো গন্ধ। বিষাক্ত বাতাসে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে বাড়ছে বায়ুবাহী রোগ-জীবানুর সংক্রমণ। নাকে-মুখে কাপড় গুজেও রাস্তা পার হতে পারেননা পথচারীরা। পাইকগাছার চাঁদখালী-কয়রা সড়কের পশ্চিম পাশ দিয়ে কয়রার নাকশা অভিমুখে সারি সারি গড়ে ওঠা কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরির শতাধিক অবৈধ চুল্লি থেকে নির্গত অবিরাম ধোঁয়ায় এমন পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। প্রভাব আর প্রতিপত্তির মুখে সরাসরি প্রতিরোধ সম্ভব না হলেও খানিকটা সোচ্চার হয়ে উঠেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগের পর এসব অবৈধ চুল্লি ধ্বংসে অভিযান শুরু করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর ও উপজেলা প্রশাসন। প্রশ্নবিদ্ধ প্রক্রিয়ায় বুধবার (৭ সেপ্টেম্বর) যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ভ্রাম্যমান আদালত এমন ৫ টি অবৈধ কয়লা তৈরির কারখানা (চুল্লি) ভেঙ্গে দেওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে এর কার্যক্রম। এ সময় আদালত আগামী এক মাসের মধ্যে সকল কারখানাসহ কয়লা তৈরির যাবতীয় সরঞ্জমাদি নিজ দায়িত্বে সরিয়ে নেওয়ারও নির্দেশনা দিয়েছেন। পরিবেশ অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আসিফুর রহমান, জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আবু সাঈদ, পরিদর্শক মারুফ বিল্লাহ, পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মমতাজ বেগমের সমন্বয়ে পরিচালিত অভিযানে উপস্থিত ছিলেন, পেশকার ইব্রাহীম হোসেন ও আনসার সদস্যরা। আদালত সূত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, এদিন অভিযান পরিচালনাকালে চুল্লিগুলো জলন্ত থাকায় বহুলাংশে ব্যাহত হয় এর কার্যক্রম। বিকল্প ব্যাবস্থা হিসেবে তাৎক্ষণিক পার্শ্ববর্তী আশাশুনি থেকে ফায়ার সার্ভিসকে ডেকে নিয়ে আগুন নিভিয়ে পরিচালিত হয় উচ্ছেদ কার্যক্রম। এর আগে এসব চুল্লি নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় গুরুত্ব সহকারে প্রতিবেদন প্রকাশ হলে দেরিতে হলেও সর্বশেষ সেখানে অভিযান শুরু করল খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তরসহ উপজেলা প্রশাসন। তবে অভিযানে স্থানীয়দের মধ্যে সাময়িক স্বস্থি ফিরলেও শঙ্কা কাটেনি। পুরোপুরি সকল চুল্লি উচ্ছেদের আগেই এর মালিকরা ফের স্বরুপে ফিরতে পারে বলেও আশংকা করছেন কেউ কেউ।
সরেজমিনে দেখা যায়, খুলনার পাইকগাছা উপজেলার চাঁদখালী-কয়রা প্রধান সড়কের পশ্চিম পাশ দিয়ে কয়রার নাকশা পর্যন্ত সারি সারি গড়ে উঠেছে অন্তত ৭০ টিরও বেশি কাঠ তৈরির অবৈধ কারখানা (চুল্লি)। এসব চুল্লিতে প্রতিদিন পুড়ছে হাজার হাজার মণ কাঠ। চুল্লি এলাকা থেকে আশপাশের কয়েক কি:মি: জুড়ে বাতাসে চুল্লি থেকে অবিরাম নির্গত বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। স্বাভাবিক নি:শ্বাস নিতেও কষ্ট হয় এসব এলাকার বাসিন্দাদের। প্রকাশ্যে গড়ে ওঠা এসব চুল্লির অবাধে নির্গত ধোঁয়ায় পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি রীতিমত স্বাস্থ্য
ঝুঁকিতে রয়েছে সুন্দরবনউপকূলীয় জনপদের লাখ লাখ মানুষ। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব চুল্লির কোনটারই নেই বৈধ কোন কাগজ-পত্র। প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়াই স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে পরিচালিত হয় এসব বায়ুদূষণ কারখানা। সূত্র জানায়, নদীর তীর, প্রধান সড়ক, স্কুল, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও জনবসতিপূর্ণ এলাকায় গড়ে ওঠা এসব চুল্লিতে প্রতিদিন পুড়ছে বিভিন্ন প্রজাতির অসংখ্য ফলদ ও বনজ বৃক্ষ। চুল্লির কাঁচামাল হিসেবে কাঠের যোগান দিতে একদিকে যেমন বন উজাড় হচ্ছে, অন্যদিকে বিষাক্ত ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্ঠ,কাঁশিসহ বায়ু দূষিত নানা রোগ-জীবানুর সংক্রমণ ক্রমশ বাড়ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিটি চুল্লিতে প্রতিবার ২০০ থেকে ৩০০ মণ পর্যন্ত কাঠের যোগান দিতে হয়। সে অনুযায়ী শতাধিক চুল্লিতে প্রতিবার ন্যুনতম ২০ থেকে ৩০ হাজার মণ কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। এভাবে প্রতিমাসে চুল্লিপ্রতি তিন থেকে চারবার কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরি করতে ৮০ হাজার থেকে এক লক্ষ মণ কাঠের যোগান দিতে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে নানা সংকটে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন শিল্প কারখানায় এসব চুল্লির কাঠের চাহিদা বেড়েছে অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি। মূলত চাহিদা ও লাভের বিষয়টিকে পুঁজি করেই কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরিতে মেতে উঠেছেন কারখানা (চুল্লি) মালিকরা। এরপর বিভিন্ন মাধ্যমে উচু দামে বিক্রি হওয়া কয়লা বস্তায় ভরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কল- কারখানায় জ্বালানি হিসেবে। এর আগে এলাকাবাসীর পক্ষে এসব অবৈধ চুল্লি বন্ধে খুলনা বন ও পরিবেশ
অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ হয়।
এব্যাপারে উপজেলা নিরাপদ খাদ্য ও সেনেট্যারী কর্মকর্তা উদয় কুমার মন্ডল জানান, কাঠ পোড়ানোর ফলে কার্বন ও সীসা উৎপন্ন হয়ে তা বাতাসে
মিশে যায়। যে এলাকায় কাঠ পুড়িয়ে কয়লা উৎপাদন করা হয়, ওই এলাকায় চুল্লির ধোঁয়ায় মানবশরীরে শ্বাসকষ্টজণিত রোগ, অ্যালার্জি, চর্মরোগ,
চোখের সমস্যাসহ নানা ধরনের রোগ দেখা দিতে পারে। পাইকগাছা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মমতাজ বেগম বলেন, কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরির কোনো অনুমতি কাউকে দেওয়া হয়নি। অভিযোগের প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে অভিযান শুরু হয়েছে। যা অব্যাহত থাকবে। পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনার উপ-পরিচালক মো: আসিফুর রহমান জানান, অভিযান শুরু হয়েছে। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের অনুরোধে কিছুদিন সময় দেওয়া হয়েছে। আগামী দিন সকল অবৈধ চুল্লি উচ্ছেদ বাস্তবায়ন করা হবে।