April 27, 2024, 11:52 am
শ্যামনগর প্রতিনিধি :
যে কোন ধরনের প্রাকৃতিক উৎস থেকে সকল প্রকার মাছের রেণু বা পোনা সংগ্রহে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় তথা সরকারের স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। দেশীয় এবং সামুদ্রিক যাবতীয় মাছের বংশ বিস্তারের বাঁধা দুরীকরণেই এমন পদক্ষেপ। যাতে পরিণত আকৃতি লাভের পর প্রজনন সক্ষমতার সুযোগে নদ-নদীসমুহে মাছের পরিমান ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। যার পেক্ষিতে প্রাকৃতিক উৎস থেকে মাছের রেণু সংগ্রহে সরকারি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে বঙ্গপোসাগর তীরবর্তী নদ-নদীতে জাল ব্যবহারে জেলেদের নিরুৎসাহিত করা হয়।সরকারি এ নিষেধাজ্ঞা মেনে অধিকাংশ জেলে বড় মাছ শিকারের জন্য জাল-দড়া নিয়ে সুন্দরবন বা সুন্দরবন সংলগ্ন নদ-নদীসমুহে দীর্ঘকাল ধরে বংশ পরম্পরায় মাছ শিকার করছে।তবে সাম্প্রতিক সময়ে এক শ্রেণির অতি মুনাফালোভী জেলে সুন্দরবন সংলগ্ন নদ-নদীসমুহ থেকে ভাঙান, পায়রা, পারশে ভেটকি, লুচো, বাগদা, হরিনাসহ বিভন্ন প্রজাতির মাছের রেণু শিকার শুরু করেছে। মুলত লোকালয়ে গড়ে ওঠা চিংড়ি ঘেরসমুহে এসব মাছের রেনু মোটা দামে বিক্রি করে স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফা অর্জনের সুযোগ থাকায় দিনকে দিন রেণু শিকারী এমন জেলের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফা লাভের কারনে তারা নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করেই দেদারছে সুন্দরবন সংলগ্ন নদ-নদী থেকে এসব রেণু শিকার অব্যাহত রেখেছে। অভিযোগ রয়েছে বনবিভাগের সাথে গোপন আতাঁতের মাধ্যমে কপোতাক্ষ, খোলপেুটয়া ও শিবসা নদী হয়ে এসব রেণুর চালান পাটকেলঘাটা ও কাশিমাড়ী এবং আশাশুনির নির্দিষ্ট ঘাটসমুহে পৌঁছায়। তথ্য রয়েছে শুধু শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ী ঘাট এলাকায় প্রায় প্রতিদিন ১২/১৩টি ট্রলারযোগে কয়েক কোটি পারশে মাছের রেণু কেনা বেঁচা হয়।অনুসন্ধানে তথ্য জানা গেছে রেণু শিকারী জেলেরা পায়রা, ভাঙাল, বাগদা, হরিনা কিংবা পাঙ্গাশ টেংরা মাছের রেণু লোকালয় সংলগ্ন পাশর্^বর্তী নদ-নদী থেকে সংগ্রহ করলেও পারশে মাছের রেণুর জন্যই মুলত তারা গভীরে যায়। যে কারণে তারা ইঞ্জিন চালিত নৌ-যান ব্যবহার করতে বাধ্য হয়, যাতে শিকারকৃত রেণু নিয়ে নির্ধারিত সময়ে লোকালয়ে ফিরতে পারে।রেণু শিকার এবং পরিবহনের সাথে জড়িত কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে পারশে মাছের কোটি কোটি রেণু বা পোনাসমুহ দলবদ্ধভাবে চলাচল করে। এসময় ব্যবহার নিষিদ্ধ বিশেষ আকৃতির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র বিশিষ্ট জাল ব্যবহার করে শিকারী জেলেরা দলবদ্ধ ঐ রেণুসমুহকে পাকড়াও করে। পরবর্তীতে বেছে বেছে তারা পারশে মাছের রেনুসমুহ রেখে বাকি রেণু চরের মধ্যে ফেলে দেয়। তাতে আরও নানান প্রজাতির কোটি কোটি মাছের রেণু নষ্ট হয়।স্থানীয় চিংড়ি ঘের মালিক ফজলুল হক ও মহিবুল্লাহসহ অনেকে জানান, স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি বর্তমানে দামও বেশ চড়া হওয়ায় তারা চিংড়ির ঘেরে পারশে মাছের রেণুও ছাড়ে। তাদের দাবি উপকুলীয় এ অঞ্চলে দিনে দিনে পারশে মাছের চাহিদা পুর্বের যেকোন সময়ের তুলনায় বেড়ে চলেছে। আর চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় লোকালয় সংলগ্ন চিংড়ি ঘেরসমুহে পারশে মাছের যোগান নিশ্চিত করতে কিছু জেলে ইঞ্জিন চালিত নৌকা নিয়ে সুন্দরবনের গভীর থেকে পারশে মাছের রেণু শিকার করে।নাম প্রকাশ না করার শর্তে পারশে মাছের রেণু শিকারের সাথে জড়িত তিন/চার জন জেলে জানান, তারা বনবিভাগকে ম্যানেজ করে সুন্দরবনে যেয়ে পারশে মাছের পোনা সংগ্রহ করে। সেজন্য ট্রলার (ইঞ্জিনচালিত নৌকা) প্রতি তাদেরকে ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা দিতে হয়। এসব জেলেরা আরও জানায় পাটকেলঘাটা হয়ে শিবসা নদীসহ কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদী দিয়েও অসংখ্য ইঞ্জিন চালিত নৌকা প্রায় প্রতিদিন গভীর রাতে পারশে মাছের রেণুর চালান নিয়ে পাটকেলঘাটা ও কাশিমাড়ী ঘাটে ভিড়ে। তারা আরও জানান পারশে মাছের রেণুর এতই চাহিদা যে ভোর রাতে ঘাটে ট্রলার লাগার সাথে সাথে বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত ফড়িয়ারা রেণু সংগ্রহ করায় দিনের আলো ফোটার আগেই আট/দশটি ট্রলারের কোটি কোটি পারশে মাছের রেণু শেষ হয়ে যায়।গত সপ্তাহে শিবসা নদী দিয়ে আশাশুনি উপজেলার তিনটি নৌকাযোগে প্রায় আঠার মনেরও বেশী পারশে মাছের রেণু আসার কয়েক ঘন্টার মধ্যে তা শেষ হয়ে যায় বলে খুটিকাটা গ্রামের ঘের কর্মচারি জহিরুল ও আব্দুল আলমি জানান।অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে শিকার নিষিদ্ধ এসব মাছের রেণু ঘাটে আসা মাত্রই সংশ্লিষ্ট ঘাটের অবৈধ ইজারাদারগনের সহায়তায় মুহুর্তেই যাবতীয় রেণু বিক্রি করা হয়। বিষয়টি অসম্পূর্ণ অবৈধ হওয়া সত্ত্বেও এসব প্রভাবশালী ঘাট মালিক ও তাদের সহযোগীরা বেআইনী এমন কাজকে রীতিমত বৈধ বানিয়ে ফেলেছে। ফলে কোন ফটো সাংবাদিক এমনকি স্থানীয়রা পর্যন্ত ছবি তুলতে গেলে তাদেরকে নাজেহাল করার ঘটনাও ইতিপুর্বে ঘটেছে বলে জানা গেছে।জানা গেছে বর্তমানে শ্যামনগর ও কালিগঞ্জ উপজেলার অধিকাংশ চিংড়ি মাছের ঘের শুকিয়ে নুতন করে চাষের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। কোন কোন ঘেরে ইতিমধ্যে পানিও উত্তোলনের কাজ শুরু হয়েছে। এসব ঘেরে অল্প কিছুদিনের মধ্যে অপরাপর মাছের সাথে পারশে মাছের রেণু ছাড়া হবে। শ্যামনগর ও পাশর্^বর্তী কালিগঞ্জ উপজেলায় গড়ে ওঠা ছোট বড় প্রায় চার হাজারেরও বেশি চিংড়িঘেরের জন্য প্রয়োজনীয় পারশে মাছের রেণু কাশিমাড়ি এলাকা দিয়ে আসবে।পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সাবেক অধ্যক্ষ আশেক-ই এলাহী জানান এভাবে যথেচ্ছা রেণু শিকারের কারণে ক্রমেই নদ-নদীতে মাছের আকাল দেখা দেবে। তাই সরকারি নীতির স্পষ্ট বাস্তবায়ন অতীব জরুরী। তিনি আরও বলেন, পারশে মাছের রেণু শিকার করতে যেয়ে অন্যান্য প্রজাতির আরও কোটি কোটি রেণু ধ্বংস হচ্ছে। এখনই যদি সাগর থেকে সব ধরনের রেণু শিকার বন্ধ না করা যায় তবে নিকট ভবিষ্যতে নদ-নদী আর সাগরে মাছের পরিমান তুলনামুলকভাবে কমে যাবে।এবিষয়ে উপজেলা সিনিয়র মৎস্য অফিসার ফারুক হোসেন সাগর জানান, প্রাকৃতিক উৎস থেকে রেণু শিকার সম্পূর্ণ বে-আইনী। পারশে মাছের রেণু শিকার করতে যেয়ে আরও নানান প্রজাতির কোটি কোটি রেণু ধ্বংস হয়। তাই বনবিভাগকে আরও দায়িত্বশীল হয়ে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকা থেকে পারশে মাছের রেণু শিকার আটকাতে হবে। তিনি আরও বলেন এধরনের রেণু শিকারের বিরুদ্ধে ১৯৫০ সালের একটি আইনে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কারাদন্ড ও অর্থদন্ডের বিধান রয়েছে।